সুপ্রভাত ডেস্ক »
কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
বুধবার রাত সাড়ে ৮টায় উখিয়া উপজেলার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে তার উপর গুলিবর্ষণ হয়।
সঙ্গে সঙ্গে তাকে উখিয়ার কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
সেখানে রাত সোয়া ১০টার দিকে মুহিবুল্লাহ মারা যান বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা শিবিরের নিরাপত্তায় থাকা ১৪ আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) অধিনায়ক পুলিশ সুপার মো. নাঈম-উল হক।
চল্লিশোর্ধ্ব এই রোহিঙ্গা নেতা মাস্টার মুহিবুল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামে একটি সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করে আলোচনায় আসেন তিনি। জেনিভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায়ও রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর এলাকার স্কুলশিক্ষক মুহিবুল্লাহ পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমে ‘রোহিঙ্গাদের কণ্ঠস্বর’ হিসেবে বিবেচিত ছিলেন।
কারা এই রোহিঙ্গা নেতাকে খুন করেছে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা তাৎক্ষণিকভাবে দিতে পারেননি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।
রয়টার্স দুই বছর আগে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, মুহিবুল্লাহ মৃত্যুর হুমকি পাচ্ছেন।
মুহিবুল্লাহ উখিয়ার ১-ইস্ট লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে থাকতেন।
পুলিশ কর্মকর্তা নাঈম বলেন, “রাতে ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকের এক দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন মুহিবুল্লাহ। এক পর্যায়ে মুখে গামছা পরিহিত একদল অজ্ঞাত দুর্বৃত্ত অতর্কিত তাকে লক্ষ্য করে পর পর পাঁচটি গুলি ছোড়ে। তার শরীরে তিনটি গুলি লাগে।”
স্থানীয় লোকজন এগিয়ে গেলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায় বলে জানান তিনি।
নাঈম বলেন, “ঘটনার খবর পেয়ে এপিবিএনের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মুহিবুল্লাহকে উদ্ধার করে কুতুপালংস্থ এমএসএফ হাসপাতালে ভর্তি করে।”
উখিয়া থানা পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এপিবিএন ও পুলিশ সদস্যরা হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।
মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে মুহিবুল্লাহ বেশ আগে বাংলাদেশে আসেন বলে স্থানীয়দের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যায়।
মিয়ানমারে নির্যাতনের মুখে দীর্ঘদিন ধরেই মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসছিলেন বাংলাদেশে। ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত ৪ লাখের মতো রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নেন কক্সবাজারে, টেকনাফ ও উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে থাকছিলেন তারা।
২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গাদের ঢল। সব মিলিয়ে এখন ১১ লাখের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে বাংলাদেশে।
২০১৯ সালে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের যে সমাবেশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা উঠেছিল, তার উদ্যোক্তা ছিলেন মুহিবুল্লাহ।
রোহিঙ্গা শিবিরে কাজ করা বিভিন্ন এনজিও ও বিদেশি সংস্থার সঙ্গে মুহিবুল্লাহর সম্পর্কও স্থানীয়দের মধ্যে আলোচিত ছিল। ইংরেজি জানার সুবাদে তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধি হিসেবে বিদেশিদের সঙ্গে আলোচনা চালাতেন।
মুহিবুল্লাহকে হত্যার খবর শুনে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার ‘গভীর শোকাহত’ হয়েছেন বলে তার মুখপাত্রের বরাতে রয়টার্স জানিয়েছে।
মুখপাত্র বলেন, “শরণার্থী শিবিরে যে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় থাকে, সেজন্য আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।”
মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর খবর শুনে শোক জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা হিউমেন রাইটস ওয়াচও।
সংস্থার দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের পরিচালক মীনাক্ষ্মী গাঙ্গুলি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “মুহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, নিরাপদ ও সম্মানজন প্রত্যাবাসনে সবসময় ছিলেন সোচ্চার।
“রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা অধিকারের কথা বলে, সহিসংতার বিরুদ্ধে কথা বলে, মুহিবুল্লাহর মৃত্যু তাদের জন্য একটি বড় ধাক্কা।”
মুহিবুল্লাহর মৃত্যু রোহিঙ্গাদের সম্মানের সঙ্গে মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার পথটি কঠিন করে তুলল বলে মন্তব্য করেন মীনাক্ষ্মী।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক বিবৃতিতে মুহিবুল্লাহ খুনের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “কক্সবাজারে শরণার্থী শিবিরে সহিংসতা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে সশস্ত্র মাদক কারবারিরা খুন করছে, জিম্মি করছে। এই ধরনের ঘটনা এড়াতে কর্তৃপক্ষের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।”
শরণার্থী শিবিরে বসবাসরতদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার প্রতিও আহ্বান জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠনটি।
মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’র উপদেষ্টা অং কিও মোকে উদ্ধৃত করে রয়টার্স জানিয়েছে, মুহিবুল্লাহর মৃত্যু রোহিঙ্গাদের জন্য বড় ক্ষতি।
“তিনি জানতেন যে তিনি হুমকির মধ্যে রয়েছেন। তবে তিনি মনে করতেন, হুমকির ভয়ে তিনি যদি তার কাজটি না করেন, তবে কে তা করবে।”
রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রচেষ্টা এখনও সফল না হওয়ায় বেশ কিছু সংখ্যককে নোয়াখালীর ভাসানচরে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হলে তার বিরোধিতা করেছিল বিভিন্ন এনজিও।
ভাসানচরে যাওয়া নিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধ দেখা গিয়েছিল। অন্তকোর্ন্দলে সংঘাতের খবরও পাওয়া গিয়েছিল বিভিন্ন সময়।
সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম