অনেক চেষ্টা করেও এখানে ট্রেন থামানো বন্ধ করা যায়নি- পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা #
বিনা টিকেটের যাত্রীদের নেমে যাওয়ার নিরাপদ স্থান এই এলাকা #
ভূঁইয়া নজরুল :
ঘড়ির কাঁটায় সকাল পৌনে নয়টা, সপ্তাহের দিনের হিসেবে গত মঙ্গলবার (৯ জুন)। চাঁদপুর থেকে ছেড়ে আসা আন্ত:নগর মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিমে থেমে গেল। না, রেললাইনের সিগন্যালে ( সংকেত) কোনো লালবাতি ছিল না। কিন্তু ট্রেনটি থেমে যেতেই ট্রেনের বিভিন্ন কোচ থেকে হুড়মুর করে যাত্রীরা নামা শুরু করলো। যাত্রীরা নামার পর ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেল। শুধু গত মঙ্গলবার ই নয়, গত সোমবার ৮ জুনও ছিল একই চিত্র। গত দুই দিন তা ফলো করা হলেও রেলওয়ের আন্ত:নগর প্রায় সব ট্রেনের জন্য প্রতিদিনই দেওয়ানহাট ওভারব্রিজ এলাকাটি যেনো অঘোষিত স্টপেজ। এমনকি মাসে এক বা দুই বার সুবর্ন বা সোনারবাংলা ট্রেনের ক্ষেত্রেও থামার ঘটনা ঘটে।
অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে ট্রেনের টিকেট, যাত্রীসেবায় তৈরি হচ্ছে অ্যাপস কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না ট্রেনের অনির্ধারিত এই স্টপেজটি। বিনা টিকেটের যাত্রীদের মধ্যবর্তী স্টেশন থেকে উঠিয়ে নামানোর জন্য এই স্থানটিকেই বেছে নেয়া হয়। করোনাকালেও থেমে নেই এই কার্যক্রম। আর একাজে রেলওয়ের এটেনডেন্ট, গার্ড, খাবার গাড়ির তত্বাবধায়ক ও টিকেট চেকারদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তারা কেউ নিজের দোষ স্বীকার করতে রাজি নয়, একে অপরের উপর দোষ চাপাতে ব্যস্ত।
দেওয়ানহাটে ট্রেন থামছে কেন ?
চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা আন্ত:নগর মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি প্রায় প্রতিদিন থামছে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিচে। সকাল ৮টা ৪৫ থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশের আগে দেওয়ানহাটে থেমে থাকে। আর সেখানে কিছু যাত্রী নামিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের নির্ধারিত প্ল্যাটফরমে থামে। তাহলে কি দেওয়ানহাট রেলওয়ের একটি স্টপেজ?
এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওপিএস) মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, এই জায়গায় শুধু মেঘনা নয়, অন্যান্য ট্রেনও থামে। অনির্ধারিত এই স্টপেজ বন্ধ করতে অনেক চেষ্টা করেও পারিনি।
এটা কি ট্রেনের চালক থামায়? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালক বাধ্য হয় থামাতে। ট্রেনের যাত্রীদের মধ্য থেকে কেউ ট্রেনের শিকল টান দিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয় এবং ট্রেনটি স্বাভাবিক কারণেই থেমে যায়।
ট্রেন থামায় যাত্রী বা এটেনডেন্ট ?
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের আগে হলো পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টেশন। পাহাড়তলী রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার আবু জাফর আহমেদ বলেন,‘ আমার স্টেশন থেকে আমি লাইন (সংকেত) ক্লিয়ার করে দিয়ে দেই জংশন কেবিনকে (টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনীর কাছে)। জংশন কেবিন তা চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনকে সিগন্যাল ক্লিয়ার করে দেয়। এতে মাঝপথে ট্রেন থামার কোনো সুযোগ নেই। তবে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে প্ল্যাটফরম খালি না থাকলে কদমতলী রেল গেইটের আগে কখনো কখনো ট্রেনকে থামাতে হয়। সেখানে একটি সিগন্যাল পোষ্ট রয়েছে। কিন্তু দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিচে থামার কথা নয়।’
গত ৮ জুন সোমবার মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনের লোকোমাস্টার (চালক) ছিলেন আবদুল আউয়াল। কোনো লাল বাতি না থাকার পরও তিনি কেন ট্রেনটি দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিচে থামালেন? এই প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমি থামাতে চাইনি। কেউ ট্রেনের শিকল টেনে ধরেছে। আর এতেই ট্রেনটি থেমে যায়।’
কিন্তু প্রতিদিনই তো এখানে ট্রেন থামার ঘটনা ঘটে তা দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন না মাঝে মাঝে হয়। যেসব ট্রেন মধ্যবর্তী স্টেশনে থামে সেসব ট্রেনগুলোর যাত্রীরা এখানে শিকল টানে এবং ট্রেন থেমে যায়। আর এই স্থানে নেমে আগ্রাবাদ বা বহদ্দারহাটের দিকের যাত্রীরা সহজে চলে যেতে পারে।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ফেনী, লাকসামসহ মধ্যবর্তী স্টেশনগুলো থেকে যেসব যাত্রী বিনা টিকেটে উঠে থাকে তাদের কাছ থেকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। আর এসব যাত্রীদের বসানো হয় খাবার গাড়ির কোচে। এতে রেলওয়ের টিকেট চেকার, খাবার গাড়ির তত্ত্বাবধায়ক, রেলওয়ে পুলিশ, এটেনডেন্ট, গাড়ির চালক ও গার্ডসহ পুরো একটি সিন্ডিকেট জড়িত। আর এসব যাত্রীদের নিরাপদে নামিয়ে দিতেই ট্রেনটিকে দেওয়ানহাট থামানো হয়।
এদিকে গত সোমবার ও মঙ্গলবার নেমে যাওয়া যাত্রীদের অনেকের কথা, ওখানে (স্টেশনে) গেলে প্ল্যাটফরমের টিকেট চেকার ধরবে। যেহেতু এটেনডেন্টদের টাকা দিয়ে টিকেট ছাড়াই এসেছি তাই এখানে নেমে একটু হেঁটে রাস্তায় গেলেই গাড়ি পেয়ে যাবো।
ট্রেনের এটেনডেন্টদের বক্তব্য
আন্ত:নগর ট্রেনগুলোর প্রতি দুই কোচের (বগির) জন্য একজন করে এটেনডেন্ট থাকে। এটেনডেন্টরা বিনা টিকেটের যাত্রীদের এনে নিরাপদে দেওয়ানহাট ওভারপাসের নিচে নামিয়ে দেন। এমন অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের এটেনডেন্ট কাউন্সিলের আহবায়ক ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি মোহাম্মদ আলী আকবর বলেন, ‘সারাদেশে ৩৩৯ জন এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৭৯ জন এটেনডেন্ট রয়েছে। তবে একথা সত্য যে অনেক সময় ট্রেনগুলো দেওয়ানহাট ওভারপাসের নিচে থামানো হয়। কিন্তু এখন করোনার মধ্যে তা হচ্ছে না।’
কিন্তু থামানোর বিষয়টি তারিখসহ উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে হয়তো মেঘনা ও পাহাড়িকার ক্ষেত্রে কিছু কিছু হচ্ছে। এই কাজটি কিছু এটেনডেন্ট করলেও করতে পারে, তবে এর সাথে ট্রেন পরিচালনায় অন্যরাও জড়িত রয়েছে।’
ট্রেন পরিচালনায় অন্যরা বলতে কারা? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি কারো নাম বলতে রাজি হননি।
এটেনডেন্ট কাউন্সিলের সভাপতির এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ট্রেন চালকের পাশাপাশি, রেলওয়ে পুলিশ ও খাবার গাড়ির তত্ত্বাবধায়করাও জড়িত থাকতে পারে।
রেলওয়ে পুলিশের বক্তব্য
ট্রেনে নিরাপত্তার জন্য পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শক বা পরিদর্শকের নেতৃত্বে তিনজন সিপাহী থাকে। সকল পুলিশ অস্ত্রধারী। ট্রেন থামানোর বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশ চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন জিআরপি থানার ওসি মোস্তাফিজ ভূঁইয়া বলেন,‘ রেলওয়ে পুলিশ সবসময় যাত্রীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে। বিনা টিকেটে যাত্রীদের শনাক্ত করার কথা টিকেট চেকারদের। তারা বিনা টিকেটের যাত্রীদের শনাক্ত করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করুক। অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নিবো। আর ট্রেন থামানোর সাথে পুলিশ কখনোই জড়িত থাকে না।’
তিনি আরো বলেন, তারপরও আপনি (প্রতিবেদক) যেহেতু বলেছেন তাই বিষয়টি আমি নিজে সরেজমিনে উপস্থিত থেকে বিষয়টি দেখবো।
খাবার গাড়ির তত্বাবধায়কের বক্তব্য
আন্ত:নগর ট্রেনের প্রতিটিতে খাবার গাড়ি রয়েছে। তবে এখন করোনার সময়ে খাবার গাড়ির কার্যক্রম বন্ধ। এই বন্ধ থাকায় এখানকার সিটগুলোতে বিনা টিকেটের যাত্রীদের বসিয়ে আনা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই অভিযোগ বর্তমানে মেঘনা এবং সিলেট থেকে ছেড়ে আসা পাহাড়িকা ট্রেনের ক্ষেত্রে বেশি। এবিষয়ে কথা হয় পাহাড়িকা ট্রেনের (চট্টগ্রাম থেকে উদয়ন হয়ে ছেড়ে যাওয়া) খাবার গাড়ির তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ পারভেজ মিঞা বলেন,‘ খাবার গাড়ির সাথে গার্ডদের রুম রয়েছে। তাই আমার গাড়িতে বিনা টিকেটে যাত্রী নেয়া হয় কি, হয় না তারাই বলতে পারবে।’
কিন্তু এই কার্যক্রমে আপনারা সকলে জড়িত রয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,‘ এর সাথে জড়িত থাকলে রেলওয়ের যারা চাকুরে তারা থাকবে। আমি কিভাবে থাকবো? আমরা তো খাবারের দায়িত্বে যে ঠিকাদার নিয়েছে সেই ঠিকাদারের লোক।’
এবিষয়ে কথা রেলওয়ে গার্ড এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল আমীন শামীমের সাথে। তিনি বলেন,‘ দীর্ঘদিন ধরে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের নিচে ট্রেন থামে। এখানে শিকল টানার কারণে চালক বাধ্য হয় থামাতে। তবে শিকল কে টানে তা আমার বোধগম্য নয়। আর ট্রেনটি থামার সাথে সাথে অনেক মানুষ নেমেও যায়। এদের সবাই যে বিনা টিকেটের এমন নয়, অনেক টিকেটধারী ব্যক্তিও নেমে যায় দূরত্ব কমাতে।
উল্লেখ্য, করোনার কারণে এখন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকামুখী সুবর্ন এক্সপ্রেস ও সোনারবাংলা ট্রেনটি চলাচল করছে। এছাড়া সিলেট রুটে উদয়ন যাচ্ছে এবং পাহাড়িকা হয়ে তা আসছে। চাঁদপুর রুটে মেঘনা আসা যাওয়া করছে। প্রতিটি ট্রেনের আসন সংখ্যার অর্ধেক টিকেট বিক্রি হচ্ছে।