জুয়েল আশরাফ :
‘চকলেট, খাবি না, চকলেট, খাবি না …’ বলে চিৎকার করতে লাগলেন রমলা আন্টি।
এই আমার এক দোষ। চোখের সামনে ভালো খাবার দেখলেই খেয়ে নিতে ইচ্ছে করে। আর আমি এমন একটা বাড়িতে থাকি, যেখানে খাবার খাওয়া থেকে ফেলা যায় বেশি। আসলে রমলা আন্টিরা হলেন বড়লোক। বাড়িতে চাকর-নওকর। চারটি গাড়ি। বাগানঘেরা আলিশান বাড়ি। তাই নিয়ে রমলা আন্টির কোনো অহংকার নেই। একেবারে সাদাসিধা আন্টি।
রমলা আন্টির মনটা একেবারে কাচের মতো স্বচ্ছ। দান-ধ্যানে দরাজ হাত। কেউ খালি হাতে আমাদের বাড়ি থেকে ফেরত যায় না।
এই বাড়িটাকে আমি আমাদের বাড়ি বলেই ভাবি মনেপ্রাণে। আসলে আমার নিজের কোনো বাড়ি নেই। বাড়ি তো কোনছার, মা-বাবা, ভাইবোন, কেউই নেই আমার। শুনেছি, রমলা আন্টি আমাকে এক হাসপাতাল থেকে কিনে এনেছেন। বাজারে জিনিসপত্র কেনা যায়, হাসপাতালে মানুষ কেনা যায়, শুনিনি কখনও। তখন আমার মাস সাতেক বয়স। কথাটা শুনে প্রথমে খুব চমকে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার আসল বাবা-মা তাহলে কে! কথাটা রমলা আন্টিকে বলতেই এমন ধমক দিয়েছিলেন যে, জীবনে ওসব কথা আর তুলি না। এখানে আমি নিজের বাড়ির মতোই থাকি। খাইদাই, টুকটাক কাজ করি, রমলা আন্টির সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় গাড়িতে ঘুরে বেড়াই।
আজকের দিনটা আমার কাছে একটু অন্যরকম। আজ রমলা আন্টিদের আত্মীয়-আপনজন বিদেশ থেকে আসার কথা। সেই উপলক্ষে আন্টি প্রচুর আচার বানিয়ে রৌদ্রে রেখেছেন ছাদে। আর বিড়ালকে দিয়েছেন মাছ সামলাতে! মানে আচারের বয়মের মুখে কাক-পাখি মুখ না দেয়, সেদিকে পাহারার দায়িত্ব আমার কাঁধে। সামলেই ছিলাম, কিন্তু মৌসুমী আমের আচারের বাহার দেখে জিবের পানি চুকচুক করতে লাগল। একটু তুলে আচারের অর্ধেকটা মুখে পুরেছি, আর হঠাৎ রমলা আন্টি এসে হাজির। ‘চকলেট, খাবি না, চকলেট, খাবি না…’ বলে এমন চিৎকার দিলেন যে, চারজন কাজের লোক, তিনজন ড্রাইভার, মালি ছাদে এসে হাজির!
বলে রাখা দরকার, আমার নাম চকলেট। কেন ‘চকলেট’ রাখা হলো, তা আমি জানি না। রমলা আন্টির মুখে একবার শুনেছিলাম, ছোট থেকে চকলেট খেতে খুব ভালবাসতাম বলে ওটাই আমার নাম হয়ে যায়। মহল্ল¬ায়-দোকানে-বাজারেতো আছেই, স্কুলের বন্ধুরাও আমাকে বলে, ‘হাই চকলেট!’
আমি স্কুলে পড়ি। কিন্তু স্কুল আমার ভালো লাগে না। এই বাড়ির লোকজনদের সঙ্গে, বাগান, বাজার, গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো, গেমস খেলা এসব নিয়ে আমার দিন বেশ কেটে যায়।
আমি আর এখন চকলেট খেতে পছন্দ করি না। আমার ভালো লাগে শুধু আচার খেতে। যেকোনো আচার আমার পছন্দ। সেদিন রমলা আন্টিকে বললাম, ’এবার চকলেট নাম ছাড়ো, আচার নামে ডাকো।’ শুনে আন্টি হাসলেন, বললেন, ‘তোর চকলেট নামই ভালো।’
‘খেয়ে নে, চকলেট, খেয়ে নে। আচারটা মুখে দিয়েছিস, যখন খেয়েই নে।’
রমলা আন্টির আশ্বাসবাণীতে লকলকে জিবের সাহায্যে মুখের ভেতর নিয়ে স্বাদ নিলাম। আমার কারবার দেখে হো-হো করে হেসে উঠল সবাই। আর রমলা আন্টি আমার দিকে তাকিয়ে খুব মিষ্টি করে হাসল একবার।
বিকেল থেকেই বিদেশি অতিথিরা আসতে শুরু করেছেন। লোকজনে ভরে যাচ্ছে বাগানঘেরা বিশাল শূন্যবাড়ি। আমি পিংপং বলের মতো এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছি।
তখনও দুপুরের খাওয়া হয়নি। একবার রমলা আন্টি বলল, ছাদ থেকে আচারের বয়মগুলো নামিয়ে আনতে। এসব কাজে আমি আরামপ্রিয়, আর অধিক খুশি। টগবগ ঘোড়ার মতো উঠে এলাম ছাদে। কিন্তু ছাদের ওপরের দৃশ্য দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া। পাজি বিড়াল তিনটা আচারের বয়মগুলোর পাশে শুয়ে আছে। মনে হয় আচারের সঙ্গে খেলেছে। শরীরে আচার-তেলে মাখামাখি। পাশে দুটো বয়ম ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো। এ কী কা-! বিড়াল আচার খায় শুনিনি কখনও। আমায় তীব্র রাগ পেয়ে বসল। বিড়াল তিনটাকে ধাওয়া করে পড়ে থাকা আচার আর কাচের টুকরো সাফ করতে থাকি। আস্তে আস্তে মনটা ভয়ংকর খারাপ হয়। আর বিড়ালের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার ইচ্ছা হলো। ধাওয়া খেয়ে বিড়াল তিনটা তখনও রেলিংয়ের ওপাশে গিয়ে চুপ করেছিল। আমি যদি তাদের ধরতে যাই রেলিং পেরোতে হবে। ধরতে পারব কিনা সন্দেহ, আগেই দেবে দৌড়। তাছাড়া রেলিংয়ের ওপাশটা বিপজ্জনক। বৃষ্টির পানি জমে শ্যাওলা স্যাঁতসেঁতে অবস্থা। একটু অসাবধানতায় পা পিছলে একেবারে তিনতলা থেকে নিচে!
মাথায় কী দুষ্টুবুদ্ধি চাপল, জানি না। রেলিংয়ের ওপাশে ছুটে গেলাম। তারপর … তারপর … সামনে একবার শুধু দেখলাম আলোর ঝলকানি। তারপর সব শূন্য। চোখের সামনেটা কেমন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে গেল মুহূর্তে। অনুভব করতে পারছি, প্রবল শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে আমার। ভূমিকম্প হচ্ছে কি? একটু কি টলে গেলাম? কারা যেন সব এসে মাটি থেকে তুলে ফেলল আমাকে। রান্নাবান্নার খালারা, মালি, ড্রাইভারেরা ছুটে এলো। তাদের মধ্যে কেউ বিকট শব্দে কেঁদে উঠল শুনতে পেলাম। মাথাটা যেন যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে। মাথার পেছনে হাত দিলাম আন্দাজে। ভেজা ভেজা লাগল কেমন। বমি বমি লাগতে শুরু করল। দেখলাম হাত আর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না আমি। কিন্তু কষ্টে নেওয়া শ্বাসের সঙ্গে আচারের গন্ধ পাচ্ছি। আমার শরীরে হয়তো আচারের তেল মেখে আছে। মনে হল একটু আচার খেতে পারলে ভালো হতো।
প্রথম প্রথম গাড়িতে বেড়াতে গেলে আমার বমি আসতো। একটু টক খাইয়ে দিলেই বন্ধ হয়ে যেতো। এখন যদি কেউ একটু আমের আচার মুখে দেয়, বমি বন্ধ হবে। প্রাণপনে নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করছি, পারছি না। আমি কি খুব উঁচু থেকে পড়েছি? অনেক উঁচু? আচারের জন্য মনটা খারাপ হচ্ছে খুব, কাচের বয়মগুলো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো পড়ে আছে ছাদে। কান্না পাচ্ছে হঠাৎ।
খুব কষ্ট করে বুঝলাম, একজন মহিলা আমার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল। আমার মুখে মৃদু মৃদু পানি ঝরিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল মহিলাটি। আলতো করে আমার গলা থেকে বেরোলো একটা শব্দ, ‘রমলা আন্টি!’
আবছা শুনতে পাচ্ছি রমলা আন্টির গলার আওয়াজ, ‘তুই সত্যিই আচার-পাগলছেলে, চকলেট, শুধু তুই ভয় পাস না। আমরা এখনই তোকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। জলদি গাড়িতে তোলেন…।
এখন আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। আসলে আমার কিছুই হয়নি। তিনতলা থেকে পড়ে গিয়েছি ঠিকই, কিন্তু দড়ি ধরে নেমেছি। আর নিচে পড়ার সময় এমন ভান করেছি যেন সবাই বুঝে আমার বড় বিপদ হয়েছে। আমি আসলে দেখতে চেয়েছি আমার প্রতি রমলা আন্টির মায়ার টান কি রকম। হাসপাতাল থেকে কিনে নেওয়া একটি ছোট্ট ছেলের কথা মনে পড়ে গেল আমার। যে কোনও দিন জানতেই পারল না তার আসল বাবা-মায়ের কথা। প্রয়োজনও হয়নি। এই যে রমলা আন্টি, আমার আচারমাখা শরীর জাপটে ধরে গাড়ির সিটে বসে আছেন, তিনিই আমার বাবা-মা, ভাইবোন, বন্ধু, আমার সবকিছু।
শাঁ শাঁ করে ছুটছে গাড়ি। গন্তব্য হাসপাতাল। এমন এক হাসপাতাল থেকে ছোট্ট একটি ছেলে কিনেছিলেন রমলা আন্টি। আজ এমন এক হাসপাতালেই সেই ছেলেকে নিয়ে ছুটছেন।