হাফিজ রশিদ খান »
পৃথিবীর বুকে অস্তিত্বমান মহৎ জাতিগুলো তাঁদের জাতির পিতা ধারণাটিকে খুব সচেতনভাবেই কোনো ধরনের সংকীর্ণ বাদ-বিতণ্ডার সীমায় আবদ্ধ রাখেননি। উদার আকাশের ব্যাপক অভ্রে জাতির পিতা ধারণার প্রতি অকুণ্ঠে তাঁরা মেলে রেখেছেন তাঁদের কৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সেই অবস্থান চির সমুন্নত রাখতে ‘জাতির পিতা’ প্রত্যয়টিকে তাঁরা ধর্ম, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বিন্যাস, লোকায়ত আচার-আচরণ ও ঐতিহ্যের অমলিন, চিরায়ত সাযুজ্যে স্থাপন করেছেন নিজেদের যৌথ মেধা ও মনীষার উদ্ভাবনী প্রয়োগ ঘটিয়ে। কারণ, জাতির পিতার পরিচয়েই কোনো জাতির প্রকৃত আভিজাত্যমণ্ডিত পরিচয়। তাঁর শৌর্য-বীর্য-মহত্ব-বীরত্বের প্রতিভাসেই জাতির সামগ্রিক অবয়বটি গড়ে ওঠে। জাতির পিতার ভাবমূর্তিতে পরিকীর্তিত মার্কিন দেশের জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মোহনদাস করম চাঁদ গান্ধির মতো মহাপুরুষের সম্মান ও কৌলিন্যরক্ষায় মার্কিন জাতি আর ভারতীয় জাতিসমূহের নানা মত-পথের মানুষগুলোর মধ্যে যে-আত্মিক ঐক্য ও আভূমি প্রণত শ্রদ্ধার প্রকাশ লক্ষ করা যায়, তা আমাদের উপর্যুক্ত ভাবনাকে পরিসর তৈরি করে দিতে প্রস্তুত। আরও লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই জাতিগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শগত বিরোধ-বিসম্বাদের ব্যাপক উপস্থিতি রয়েছে। সেখানে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সেসবের কৃত্যে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা আছে, বর্ণ ও জাতপাতের বহুকৌণিক বিভাজনও সেখানে কম নেই। এসবের ভেতরেই আবার বেঁচে থাকার পক্ষে পোক্ত সামাজিক অবস্থান নির্ণয় ও তা অধিকার করে রাখার দুর্বার আকাক্সক্ষায় বহুবিধ দার্শনিক, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক এবং লোকায়ত বিশ্বাস, সেসব নিয়ে নতুন-নতুন ভাবনা-বিশ্লেষণ, সভা-সমাবেশ, তর্ক-বিতর্ক, এমনকি রক্তাক্ত সংঘর্ষের বহু কাহিনি ও ইতিবৃত্তও আছে ওসব দেশে-দেশে। কিন্তু তারপরও জাগতিক প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির ওইসব উল্লাস বা অবসাদ তাঁদের চিত্তাকাশে মুদ্রিত জাতির পিতা ধারণার মহান প্রতিকৃতিতে কোনো অশ্রদ্ধার দাগ, ধুয়ো বা জুগুপ্সার কালিমালেপনের অবকাশ রাখেনি। তাই স্ফটিকস্বচ্ছ শালীনতার ওই সৌম্য আচরণকলা তাঁদের জাতিগতভাবে অর্জিত গুণাবলি বলেই ধরে নিতে হবে। জাতির গৌরব ও গর্বকে প্রতিপালনে এই শালীনতাবোধ তাঁদের হৃদয় ও চেতনাগত ঋদ্ধির অনন্যসাধারণ দ্যোতকও বটে। তাঁরা যেহেতু এই পৃথিবীর বুকে নিরন্তর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে নিজেদের অস্তিত্ব ও অবস্থানে সুদৃঢ়ভাবে আস্থাশীল আর উত্তরোত্তর উন্নতি ও সমৃদ্ধির পক্ষে যুযুধান, তাই জাতির পিতা নামক ওই যুগপৎ জাগতিক ও পরমাত্মিক ভাবমূর্তিকে তাঁরা উচ্চতম মিনারে রাখতে কসুর করেননি। এটাকে জাতিগত বা যৌথ অবচেতনার আনুগত্য বলেও শনাক্ত করা চলে। অন্যদিকে এ-প্রথা স্বাদেশিকতার মনোরম সংহতির প্রকাশও (নিজেদের ভেতর বিদ্যমান জাতপাত-বর্ণ-গোত্র, রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি নানা কৌণিক মিল-অমিলের উপস্থিতি সত্ত্বেও)। বলা যায়, এটি হলো মন্ময়ভাবে নিজেদের সম্পূর্ণ উদারভাবে উজাড় করে দিয়ে দেশজ পরিপ্রেক্ষিত থেকে পরম তৃপ্তিলাভের পরাকাষ্ঠা। এই অনুভূতির পবিত্র বিস্তার ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত বৃত্তাবদ্ধতার অন্ধকার ও হীনন্মন্যতার গহ্বর থেকে জাতিকে সার্বিকভাবে উদ্ধার ও পৃথিবীর বুকে তাকে সাবলীলভাবে বিচরণশীল করে রাখতে অনবদ্য ভূমিকা রাখে।
উল্লিখিত অনুভূতিমালা প্রকাশের পেছনে রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর প্রজন্মের অভিব্যক্তির প্রকাশ হিশেবে বর্তমান লেখকের কিছু চিন্তন ও অনুভাবনা লিপিবদ্ধ করার খেয়াল। রাজনৈতিক দলের কর্মী ও সংগঠক, তা থেকে ক্রমে বঙ্গবন্ধু, পরিশেষে জাতির পিতাÑ এই হিরণ¥য় তকমায় অভিষিক্ত হবার মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কাণ্ডারিরূপে শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য জীবনগাথা আমাদের অবশ্যই অনুপ্রাণিত করে। এই মহান দরদি ও সাহসী কণ্ঠস্বর বহু শতাব্দীর অন্ধকার থেকে আলোর উৎসে এনে দেন আমাদের। আবার এও সত্য, পরস্পরবিরোধী ভাবাবেগ আর যুক্তির শাণিত ধারাস্রোতেও ভাসিয়ে নেয় তাঁর জীবন-আলোচনার বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। তাঁর নামের আগে উল্লিখিত ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’, ‘জাতির পিতা’ : এই প্রত্যেকটি অভিধাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে সংখ্যাহীন গবেষণা সন্দর্ভ, চিত্তজয়ী কাব্য, গণগান, অসামান্য গল্পগাথার সমাহার, যুগস্পন্দিত প্রবন্ধ, নাট্যসম্ভার ও চলচ্চিত্র। তাঁর জীবনের কালানুক্রমিক বিবরণে তাঁর মহৎসত্তাকে উন্মোচন করেছেন বহু দেশি-বিদেশি প্রথিতযশা বিদ্বান ও ইতিহাসকার এবং সাংবাদিক। দেশপ্রেমিক সচেতন গীতরচয়িতারা কথার মাধুর্যে আর নান্দনিক সুরের সারথিরা সুশ্রাব্য ধ্বনির ধৈবতে শতধারায় সুকীর্তিত করেছেন তাঁর অমর নাম। কেননা তিনি চুলচেরা ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ও আলোচনার অনুপুঙ্খতায় এ ভূভাগের নিপীড়িত-নির্যাতিত বাঙালি জাতিসত্তার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির প্রকৃত পথিকৃৎ। তিনিই বিশ্বের বুকে প্রত্নবাঙালি জাতিধারণার সুস্পষ্ট বাস্তব ও প্রদীপ্ত রূপকার। সমান্তরালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অকুতোভয় ও যশস্বী নির্মাতা। জীবনসত্যের জঙ্গম, ইতিহাসচেতনার সুগভীর তাগিদ ও স্বাতন্ত্রিক জাতিসত্তার স্বপ্নময়তায় তাঁর জন্মের আগে, তাঁর প্রায় স্বল্পকালীন জীবদ্দশায় (১৯২০-১৯৭৫) বহু ক্ষণজন্মা বাঙালিসন্তান স্বজাতি ও স্বভূমির রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক, কাব্যিক ও নান্দনিক উত্থানের অনুকূলে লড়াই-সংগ্রাম ও যশোগাথা রচনায় ব্যাপৃত ছিলেন, এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা অহেতুক বাগবিস্তারের সুযোগ নেই কারো। এবং জাতীয় মুক্তির অনুকূলে আন্দোলন, বিক্ষোভের পরিণতিতে তাঁদের অনেকেই নিরতিশয় দুর্ভোগ ও যন্ত্রণাও বরণ করেছেন হাসিমুখে, এও সত্য। তাঁর পূর্বসূুরি ও সমসাময়িক এইসব মহাতেজী বাংলার জ্যোতিষ্কদের অবদান কোনোভাবেই বিস্মৃত হবার নয়। তাঁদের মনীষাবিধৃত সিদ্ধান্ত, রক্ত-শ্রম-ঘাম ও ত্যাগের আলোকচ্ছটায় ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শৃঙ্খলকবলিত জাতি নিদানস্বরূপ সাময়িক স্বস্তি ও শক্তি অর্জন করে জীবনের দিকে আশাভরা দৃষ্টি মেলে বাঁচার প্রণোদনা পেয়েছিল, তাতে দ্বিমতের অবকাশ নেই। অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় আমরা তাঁদের বরণ করতে পারি এভাবে যে, তাঁরা সম্মিলিতভাবে ছিলেন জাতীয় চৈতন্যের বীজতলার নির্মাতা। আর কালের উৎকৃষ্ট কৃষক যে-বলিষ্ঠ চারাটি ওই বীজতলা থেকে চয়ন করেছেন পরমযত্নে তাঁরই নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বীজতলার সবল চারাটিই পুষ্ট ধান্যরসে বলবন্ত হয়ে জাতির সার্বিক রাজনৈতিক মুক্তির ক্ষুধা-নিবৃত্তিতে নিয়োজিত হয় প্রবল প্রতাপে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম, বেড়ে ওঠা, যৌবনপ্রাপ্তির সময়গুলো ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কালখণ্ডের অন্ধকার সময়ে। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের ‘বেকার হোস্টেলে’ অধ্যয়নকালে তাঁর পরিচালিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড তাঁর ভেতরের জাতীয় মুক্তিকামী সত্তাটিকে পরিপূর্ণরূপে উন্মোচিত হবার পরিসর গড়ে দেয়। তখন তিনি ছাত্রসমাজের দিশারিরূপেও সক্রিয়। সময়টা ১৯৪৪-৪৫ সাল। ভারতবর্ষের মাটি থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের শেষচিহ্নটি উপড়ে ফেলে মুসলমানদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এ আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিশেবে তাঁর নিজস্ব অনুধাবনা ছিল এ রকম : ‘অখণ্ড ভারতে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না, এটা আমি মনপ্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম।’ [অসমাপ্ত আত্মজীবনী; শেখ মুজিবুর রহমান, পৃ. ৩৬]।
তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে অপেক্ষাকৃত প্রগতিশীল অংশটির নেতৃত্বে সমাসীন ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম। সেই সময়ের যুবনেতা শেখ মুজিব এঁদেরই রাজনৈতিক পথ ও মতে দীক্ষিত ছিলেন। মুসলিম লীগের এই প্রগতিশীল দাপুটে অংশের দূরদর্শী রাজনৈতিক আকাক্সক্ষা প্রস্ফুটিত হয় বঙ্গবন্ধুর আরও একটি উক্তিতে। সেই উক্তির কিয়দংশ এখানে উদ্ধার করা যাক : ‘মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠান পূর্বে ছিল খানসাহেব, খানবাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীদের হাতে, আর এদের সাথে ছিল জমিদার, জোতদার শ্রেণীর লোকেরা। এদের দ্বারা কোনোদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হত না। শহীদ সাহেব ও হাশিম সাহেব যদি বাংলার যুবক ও ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগকে জনপ্রিয় না করতে পারতেন এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে টেনে আনতে না পারতেন, তাহলে কোনোদিনও পাকিস্তান আন্দোলন বাংলার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারত না। যদিও এই সমস্ত নেতাদের আমরা একটু বাধা দিতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করতে পারি নাই। যার ফলে পাকিস্তান হওয়ার সাথে সাথেই এই খানবাহাদুর ও ব্রিটিশ খেতাবধারীরা তৎপর হয়ে উঠে ক্ষমতা দখল করে ফেলল।’ [ঐ ; পৃ. ৩৫]।
যে-পাকিস্তান বানাতে বঙ্গবন্ধুর জীবনের একটি সবিশেষপর্ব নিরলসভাবে ব্যয়িত হয়েছিল, সেটির পেছনে ছিল ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ বাংলার আরেক শার্দূল এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্রস্তাবের এই মর্মবাণী, যেখানে বলা হয় : … that the areas in which the Muslims are numerically in a majority as in the north-western and eastern zones of India should be grouped to constitute `independent states’ in which the constituent units shall be autonomous and sovereign.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা ওই সম্ভাব্য ক্ষমতাকেন্দ্র আপাত অপহৃত হলেও লাহোর প্রস্তাবের সুদূরপ্রসারী চেতনার ধারণ ও বাস্তবায়ন থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর রাজনৈতিক সাথি-সারথিরা। তারই সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ হিশেবে এলো ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রকৃষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষণগুলো। পরবর্তীকালের ঐতিহাসিক পথরেখা জ্বলজ্বলে অক্ষরে যা খোদিত করে রেখেছে। বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও লেখক কামরুদ্দীন আহ্মদের ভাষায় : ‘১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাকে সরকারী ভাষায় উন্নীত করার গতিবেগ বর্ধিত হল। মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হল, তা’ বাংলা ভাষার দাবীকে দিল আরও সুস্পষ্ট রূপ, বাংলাকে গ্রহণ করতে হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে, এই হল তাদের বক্তব্য। ১১ই মার্চ প্রদেশব্যাপী ছাত্রধর্মঘট আর বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হল। ছাত্ররা স্কুল-কলেজ থেকে বের হয়ে এসে বড় বড় মিছিল বের করল ঢাকার রাস্তাগুলিতে। পুলিশ বলপ্রযোগ করে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা করল। শত শত ছাত্র গ্রেফতার হল। ১২ তারিখের বিক্ষোভ প্রদর্শন আরও অধিক তীব্র আকার ধারণ করল এবং ১৪ তারিখে দাবানলের মত তা’ ছড়িয়ে পড়ল সারা প্রদেশে। স্যার নাজিমুদ্দিন ভীত হয়ে পড়লেন। বিশেষ করে ১৯ শে মার্চ জিন্নাহ্ সাহেবের ঢাকা আগমন এই ভীতির একটা বিশেষ কারণ ছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এটাই ছিল তাঁর প্রথম এবং শেষবারের মত ঢাকা আগমন। নাজিমুদ্দিন বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়কের কাছে আপোষের জন্য পাঠালেন। সংগ্রাম পরিষদ ফজলুল হক হল মুসলিম ছাত্রাবাসে তাদের দাবী প্রণয়নের জন্য মিলিত হল।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিপ্রায় ছিল আলাপ-আলোচনার সময় চীফ্ সেক্রেটারী উপস্থিত থাকবেন, কিন্তু তিনি তাতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী সবগুলি দাবীই মেনে নিলেন এবং পরদিন ১১টা ৩০ মিনিটের সময় তিনি এবং সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক চুক্তিনামায় স্বাক্ষরদান করলেন। অতঃপর ঢাকা জেলে অবরুদ্ধ নেতৃস্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরিস্থিতি আলোচনা করার জন্য আহ্বায়ককে অনুমতি দেওয়া হল। বাংলাকে সরকারী ভাষা এবং শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব বিধানসভায় উত্থাপন করলেন নাজিমুদ্দিন এবং তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হল। ১৫ তারিখে সূর্যাস্তের পূর্বেই কারার অন্তরালে অবরুদ্ধ সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হল এবং সংবাদপত্রগুলির উপর থেকে প্রত্যাহার করা হল সমস্ত নিষেধাজ্ঞা। জীবনযাত্রায় ফিরে আসতে লাগল স্বাভাবিকতা।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জিন্নাহ্ সাহেব সম্ভবত অবাঙ্গালী সেক্রেটারীদের পরামর্শ মত চুক্তির শর্তগুলিকে অস্বীকার করে বসলেন এবং ঢাকার ঘোড়দৌড় ময়দানের জনসভায় তিনি ঘোষণা করলেনÑ উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এতে একদল লোক সে সভা থেকে প্রতিবাদ করে বের হয়ে গেল। বাঙ্গালী মানসে এত বড় আঘাত লাগল আর ছাত্ররা এত ক্রুদ্ধ হল যে, তারা সমস্ত শিক্ষায়তন থেকে তাঁর ছবি অপসারণ করল। ঐতিহ্যবাহী ঢাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা জিন্নাহ্ সাহেবকে জোর গলায় জানিয়ে দিলÑ ভাষা সম্পর্কে যদি তাঁর মত পরিবর্তন না হয়, তাহলে তারা তাঁকে তাদের সভায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করতে অস্বীকার করবে। জিন্নাহ্ সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সমাবর্তন বক্তৃতায় পুনরায় উচ্চারণ করলেন তাঁর সেই পূর্ব উক্তি, আর সংগে সংগে সভায় শুরু হলো এক ভীষণ গোলযোগ। ফলে, বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই তিনি সভাকক্ষ থেকে চলে গেলেন।
জিন্নাহ্ সাহেব তাঁর জীবনে এই প্রথমবার এত অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন। সংগ্রাম পরিষদের সভ্যদের সংগে ২১ তারিখ বিকেলে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হবেন বলে তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। আলোচনার প্রারম্ভেই জিন্নাহ্ সাহেব বললেন যে, স্যার নাজিমুদ্দিনের সংগে সংগ্রাম পরিষদের যে চুক্তি হয়েছিল, সরকার তা’ মানতে রাজী নয়; কারণ উক্ত চুক্তিতে জবরদস্তির মাধ্যমে তাঁর স্বাক্ষর আদায় করা হয়েছে। যখন তাঁকে বলা হল, উক্ত চুক্তির ভিত্তিতে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, তখন তিনি উত্তর করলেনÑ এজন্য বিক্ষোভকারীদের তরফ থেকে আইন পরিষদের সদস্যদের ভয় প্রদর্শন করা হয়েছিল। তিনি যুক্তি প্রদর্শন করলেন, যদি সমগ্র দেশে একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা না থাকে, তাহলে কোন স্থায়ী সরকার সম্ভব নয়। এক ভাষার মাধ্যমেই সম্ভব হবে পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে একতা আনায়ন। তিনি আরও প্রতিপন্ন করতে চাইলেন, উর্দুকেই গ্রহণ করা সমীচীন হবে, কারণ উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই ভাষা নয়। সুতরাং এই কারণেই পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতির অধিবাসীদের মধ্যে কোন বিদ্বেষ থাকবে না। তিনি প্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমেরিকার অধিবাসীরা মূলতঃ ভিন্ন ভিন্ন দেশাগত হলেও ইংরেজী সেখানকার একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গৃহীত হয়েছে।
জিন্নাহ্ সাহেবের যুক্তির উপরে সংগ্রাম পরিষদের সভ্যরা তাঁকে প্রশ্ন করলেন, রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ যেখানে গণপরিষদের করার কথা, সেখানে তাঁর এ প্রকার ঘোষণা কি গণতন্ত্র-বিরোধী হচ্ছে না? সভ্যরা তাঁকে জানিয়ে দিলেন, এ বিষয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করতে পারেন বা নেতা হিসাবে দেশকে উপদেশ দিতে পারেন, কিন্তু দেশের সাংবিধানিক ব্যবস্থা নির্ধারণ করার কোন আইনগত অধিকার তাঁর একার নেই। তাঁরা আরও বললেন, সোভিয়েট রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশে একাধিক রাষ্ট্রভাষা থাকা সত্ত্বেও সেখানে স্থায়ী সরকার বিদ্যমান। এ কথা মিথ্যা যে, একটি রাষ্ট্রভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ঐক্য আনা সম্ভব; কারণ আমেরিকা এবং আয়ার্ল্যান্ড এক ভাষাভাষী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটেনের সংগে একত্র থাকতে পারেনি। তর্ক প্রসঙ্গে সভ্যরা উল্লেখ করলেন, কোন দেশের একতা বজায় থাকতে পারে তখনই, যখন সেখানে প্রবর্তন হবে এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাÑ যা এক অংশকে অপর অংশের দ্বারা শোষণের হাত থেকে রক্ষা করবে। তাঁরা নিবেদন করলেন, রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার জন্য দেশের বাইরে থেকে যদি কোন ভাষা আমদানী করতেই হয়, তাহলে সেটি ইংরেজী হবে না কেন? ইংরেজী একটি আন্তর্জাতিক ভাষা এবং এর সাহায্যে বহির্জগতের সংগে যোগাযোগ রক্ষা করা ছাড়াও দেশের পক্ষে সর্বাধুনিক বৈজ্ঞানিক আর কারিগরি জ্ঞানের সহিত অবহিত হওয়া সম্ভব হবে, বাংলা এবং উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে দেশের দুই অংশকে একত্র রাখার জন্য কেন্দ্রীয় দফতরের ভাষারূপে ইংরেজীকে গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে। আর ভাষা সম্পর্কে যদি আমেরিকার উদাহরণ গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে রাষ্ট্রভাষা হবার দাবী একমাত্র বাংলারই। কারণ, পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন জনের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা, পাঞ্জাবী হচ্ছে শতকরা সাইত্রিশজনের, আর অবশিষ্ট শতকরা সাতজনের ভাষা সিন্ধী, পশ্তু, উর্দু ও বেলুচী।
জিন্নাহ্ সাহেব তর্ক বরদাস্ত করতে পারলেন না, তাঁর শেষকথা হলÑ উর্দুকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে, যেহেতু ভারত গ্রহণ করেছে হিন্দীকে। এ বিষয়ে তিনি আর কোন আলোচনা করতে চাইলেন না। ফলে, উভয়পক্ষের মধ্যে হল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং সম্পূর্ণ হট্টগোলের মধ্যে বৈঠকের পরিসমাপ্তি ঘটল।
[পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি; পৃষ্ঠা. ১০৬-৯]
এরপর অসমাপ্ত আত্মজীবনী থেকে কিছু অংশ পাঠ করা যাক : ‘১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহর পুরাপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থানত্যাগ করার পর আরেক দল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হক হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। … আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা অত্যাচার ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর্মী আহত হয়ে গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের দিক থেকে নতুন কর্মী নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটছি, এর মধ্যে শামসুল হক সাহেবকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে গেছে। তখন আমার কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপি জিপ নিয়ে বারবার তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। একজন সহকর্মী দাঁড়ান ছিল, তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার-পাঁচজন ছাত্র নিয়ে আবার ইডেন বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে দিলাম তাকে বললাম, শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে পারব না। আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে বসে পড়ল। আমাদের উপর কিছু উত্তম-মধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে তুলল। … আমাদের প্রায় সত্তর-পঁচাত্তর জনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যার সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল।’ … (পৃ, ৯২)।
এবার আমাদের প্রতিপাদ্যের পক্ষে উপর্যুক্ত আলোচনা ও ঐতিহাসিক তথ্যসম্ভার থেকে কিছু উপাদান উদ্ধার করা যাক, যেমন :
১ . ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর বা পাকিস্তান প্রস্তাবের সেই অংশটুকু, যেখানে বলা ছিল : ‘ভারতের উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলসমূহে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সে সকল ভৌগোলিক এলাকায় প্রদেশগুলির মধ্যে কিছুটা রদবদল করে সার্বভৌম ও স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করে এবং সেসব আঞ্চলিক দেশসমূহের প্রদেশগুলিও হবে স্বায়ত্তশাসিতÑÑ এ মূলভিত্তি মেনে নেয়া না হবে, তা কিছুতেই কার্যকরী হবে না বা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।’
২. তৎকালীন পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের যে চুক্তি হয়েছিল এবং তা গণপরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলেও [১৫ মার্চ, ১৯৪৮] মুহম্মদ আলি জিন্নাহ কর্তৃক তা সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা। তাঁর উক্তি ছিল এ রকম : ‘সরকার তা’ মানতে রাজী নয়; কারণ উক্ত চুক্তিতে জবরদস্তির মাধ্যমে তাঁর (মুখ্যমন্ত্রীর) স্বাক্ষর আদায় করা হয়েছে।’
৩. ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের বিভিন্ন সময়ে ঢাকার ঘোড়দৌড় (রেসকোর্স) ময়দানের অভিভাষণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন অনুষ্ঠান এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার (২১ মার্চ), এই তিন স্থানেই ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ : জিন্নাহর একগুঁয়েমিভরা দম্ভোক্তি।
৪. ‘পাকিস্তানের শতকরা ছাপ্পান্ন জনের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা, পাঞ্জাবী হচ্ছে শতকরা সাঁইত্রিশজনের, আর অবশিষ্ট শতকরা সাতজনের ভাষা সিন্ধী, পশ্তু, উর্দু ও বেলুচী।’
উপর্যুক্ত ঘটনাবলির প্রত্যেকটির সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণ, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জনসমক্ষে সেসব উপস্থাপনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন মাত্রায় অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। এমনকি পাকিস্তান রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে অনন্যসাধারণ কর্মযোগীর ভূমিকা রেখেও পরবর্তী সময়ে ওই রাষ্ট্রের ভেতরকার ভেদমূলক ও কদর্য সাম্প্রদায়িক কলকব্জার মরচের সঙ্গে জড়িয়ে না-গিয়ে দূরদর্শী রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রজ্ঞায় জাতির জন্যে অভ্রান্ত পথরেখা নির্ণয় করেছিলেন। সত্য বটে ইতিহাসের নিষ্ঠুর ও বঙ্কিম ভ্রƒভঙ্গির নির্দেশে সেকালের অগ্রগণ্য মুসলমান সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বগণের সমান্তরালে তাঁকেও পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম তরুণ স্বাপ্নিকরূপে পাওয়া যাচ্ছে। কারণ, ভারতভাগের অনিবার্য ডামাডোলে সেকালের জাজ্বল্যমান বাস্তবতার আলোকে মুসলমানদের জন্যে আলাদা দেশ বা ভূখণ্ডের প্রয়োজনীয়তা ছিল তর্কাতীতভাবেই সত্য। এই বাস্তবতার ভেতরের আরো গভীর বাস্তবতা ছিল লাহোর প্রস্তাবের সেই ধারা, যেখানে ছিল ‘স্বায়ত্তশাসিত’ প্রদেশসমূহ বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতার ইঙ্গিত। এর সুদূরপ্রসারী লক্ষে পৌঁছাতে হলে আপাতভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অতি অবশ্যই শক্ত অবস্থান নেয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। আবার দেখা গেল, সেই রাষ্ট্রটি গঠিত হবার পর দ্রুতই মোহভঙ্গ হতে থাকে তৎকালীন পূর্ববাংলার সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী ও জনসমাজের। যে-প্রত্যাশা নিয়ে ওই রাষ্ট্রনির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন সেই রাষ্ট্রের সূচনাতেই তাঁরা দেখলো, রাষ্ট্রভাষাকেন্দ্রিক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার শনৈ শনৈ উন্মেষ ঘটে চলেছে। এই চেতনাধারাই ধীরে-ধীরে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনের নামে শোষণ ও জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালিকে দিন-দিন ক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদমুখর করে তোলে। এই বিক্ষুব্ধতার অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সুস্পষ্ট নেতৃত্বে চলে এলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রখর ইতিহাসবোধ, তেজস্বী জনজাগরণী অভিভাষণসমূহ, সঠিক রাজনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণের জাদুকরি গুণ, পূর্ববাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনের গভীরতলে ডুব দিয়ে তাদের চাওয়া-পাওয়ার নিবিড় আবেদন উপলব্ধির অসাধারণ ক্ষমতা তাঁকে তাঁর কালের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে তিনি যে ছয়দফা দাবিনামা উত্থাপন করলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে তা যে লাহোর প্রস্তাবের অন্তর্নিহিত চেতনার আলোকে সেটি অনুধাবনে সাধারণ মানুষের বিন্দুমাত্র কালক্ষয় হলো না। অন্যদিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে ওই ছয়দফাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের আইন ও বিধিবিধানের সমান্তরালে জনসাধারণের আইন ও বিধিবিধানে রূপান্তরিত হলো। মুক্তপক্ষ বিহঙ্গমালার মতো জনতার সকল ভাবনা-চিন্তা তথা ঝোঁক-প্রবণতা ধাবিত হলো ওই ছয়দফা নামক মহাসনদের বৈকুণ্ঠে। ১৯৬৯ সালের মধ্যে সেই বাঁধভাঙা জাগরণ চূড়ান্তভাবেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি নাড়িয়ে দিল। আর পরবর্তী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে তাঁর অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতৃত্ব প্রবলভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আরো জনপদের আনাচ-কানাচে। সকল কণ্ঠের ঊর্ধ্বে ওই কণ্ঠের পরাক্রান্ত অবস্থান জনসাধারণকে তাঁর অভ্রান্ত নেতৃত্বের প্রতি গভীরভাবে বিশ্বাসী ও আস্থাশীল করে তোলে। আর সেই আস্থাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিপক্ষে নতুন রাষ্ট্রগঠনের শক্তিমত্ত ভ্রƒণ প্রথিত করে প্রত্যেক বাঙালির মস্তিষ্কের কোষে-কোষে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ গণমানুষের রাজনৈতিক অধিকারের মুক্তিদাতা নেলসন ম্যান্ডেলা’র (১৯১৮-২০১৩) নামের শেষাংশ ছিল ‘রোলিহলাহলা’। এই আফ্রিকীয় শব্দটার ইংরেজি অর্থ ‘ট্রাবলমেকার’। কী অদ্ভুত তাৎপর্যপূর্ণ নাম! তিনি তো আসলেই (সম্পূর্ণ ইতিবাচক অর্থে) ছিলেন শ্বেতাঙ্গ শাসকদের বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক ও কালো মানুষের মানবাধিকার দলনকারী অপকর্মের বিরুদ্ধে সত্যিকার অর্থেই তাঁদের শয়নের আনন্দ হারাম করে দেয়া ‘সমস্যা সৃষ্টিকারী’ এক সার্বক্ষণিক আতঙ্কবিশেষ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুও বাঙালি জাতির প্রতি জাতিতাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয়ভাবে বৈষম্যপোষণকারী পাকিস্তান রাষ্ট্রচালকদের বিরুদ্ধে ছিলেন সেই একই রকমের ‘ট্রাবলমেকার’। শোষক ও বঞ্চনাকারীদের বিরুদ্ধে যে ‘সংকট সৃষ্টিকারী’ তাঁর জাতির জন্যে নিয়ে আসে অনাবিল স্বাধীনতা ও মুক্তির পরিপূর্ণ পার্থিব আনন্দ।