সুপ্রভাত ডেস্ক »
বিশ্ব ব্যাংকের কম সুদের ঋণ কর্মসূচির তহবিল আইডিএ থেকে বাংলাদেশ সব দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ পেয়েছে; যার পরিমাণ ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
একইভাবে বাংলাদেশকে ঋণদানকারী বিভিন্ন সংস্থা বা দেশের মধ্যে বিশ্ব ব্যাংক রয়েছে তালিকার শীর্ষে। উন্নয়ন কার্যক্রম বা কর্মসূচি বাস্তবায়নের অর্থায়নে ক্রমে অংশগ্রহণ বাড়ছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাইকা, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) কিংবা চীনের নেতৃত্বাধীন নতুন এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) মত উন্নয়ন সহযোগীদের।
বন্ধুপ্রতীম দেশ হিসেবে ঋণ দিতে পিছিয়ে নেই চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়াসহ পশ্চিমা দেশ এবং সরকারের সংশ্লিষ্টতা থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও।
শুধু সরকারি প্রকল্পে নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নয়ন সহযোগীদের অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাণিজ্যিক অর্থায়ন বা বিনিয়োগও পাচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ও আর্থিক কোম্পানি।
অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা একে বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার প্রকাশ হিসেবেই দেখছেন। ঋণ পরিশোধের অতীত ইতিহাস, ধারাবাহিকতা আর সক্ষমতার কারণেই বাংলাদেশ অর্থ লগ্নিকারীদের আস্থার জায়গায় পৌঁছেছে বলে মনে করছেন তারা।
তাদের মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাই ভারত বাদে সার্কের অন্য দেশের চেয়ে এদেশকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থায়নকারী সংস্থা ও দেশের কাছে এগিয়ে রেখেছে। আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সিগুলোও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ঋণমান সূচক স্থিতিশীল রেখেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব দেখা গেছে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের অর্থায়নে।
গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি ঋণ
বাংলাদেশের বৈদেশিক অর্থায়ন দেখভালকারী সংস্থা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ শেষে ক্ষমতায় আসার পর বর্তমান সরকার উন্নয়নে ব্যাপক মনোযোগ দেওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে গত ১০ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণ ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে। এখন এক লাখ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়নেও হাত দিয়েছে সরকার; যেটির অর্থায়নের প্রায় সিংহভাগই আসবে বিদেশ থেকে।
শুধু চলতি অর্থবছরেই সরকার ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিদেশি অর্থায়ন পাওয়ার আশা করছে। গত এক দশকে প্রতি অর্থবছরে সরকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর (এডিপি) পরিমাণ বাড়িয়েছে; সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
গত ১০ অর্থবছরে দাতা দেশ ও উন্নয়ন সহযোগীরা মোট ৯ হাজার ৮২ কোটি (৯০ দশমিক ০৮ বিলিয়ন) ডলার ঋণ দিতে চুক্তি করেছে। এরমধ্যে ছাড় করেছে ৪ হাজার ৬৬৬ কোটি (৪৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন) ডলার।
এর আগের ২০০১-০২ অর্থবছর থেকে ১০ বছরে ছাড় হয়েছিল এক হাজার ৫৬৮ কোটি ডলার। অর্থাৎ ১০ অর্থবছরের ব্যবধানে বৈদেশিক ঋণ ছাড় প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়েছে। আর সবশেষ ১০ অর্থবছরে প্রতিশ্রুতিও বেড়ে প্রতি অর্থবছরে গড়ে দাঁড়িয়েছে ২ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে আগের ১০ অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৮৮ শতাংশ বেড়েছে।
ঋণ দিতে আগ্রহ বাড়ছে কেন
বাংলাদেশকে ঋণ দিতে সব উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা দেশেরই আগ্রহ রয়েছে জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার কোনও প্রকল্প নিয়ে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছে ঋণের আবেদন জানালে তারা খুবই ইতিবাচকভাবে দেখে।
“শুধু পদ্মা সেতুর ওই ঝামেলা ছাড়া এপর্যন্ত কোনও প্রকল্প নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হয়নি। যত প্রকল্পে ঋণ চাওয়া হয়েছে, প্রায় সবগুলোতেই তা পাওয়া গেছে।“
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএস এর সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত এক দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণেই দাতারা বাংলাদেশে ঋণ দিতে বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার হাত ধরে সামষ্টিকসহ দেশের অর্থনীতির সকল ক্ষেত্রেই উন্নতি করছে। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে।
“ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাবনা দেখলেই সেখানে ঋণ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশেও সম্ভাবনা দেখছে এজন্যই ঋণ দিচ্ছে।“
তার ভাষ্য, এক দশক আগেও জাপান বাংলাদেশকে খুব বেশি ঋণ দিত না। কিন্তু গত ১০ বছরে দেশটি ব্যাপকভাবে ঋণ দিচ্ছে। এর পেছনে কারণ হচ্ছে জাপান মনে করে বাংলাদেশ এখনও একটি জনমিতিক সুবিধার দেশ। এদেশে বিনিয়োগ করলে বাজার এবং জনশক্তি পাওয়া যাবে। তাই বিনিয়োগ সুবিধা নেওয়ার জন্য অবকাঠামো তৈরি করতে দেশটি বিপুল ঋণ দিচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংক কী বলছে
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে বিশ্ব ব্যাংকের সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানানো হয়, বাংলাদেশের শক্তিশালী সামষ্টিক অর্থনীতি, শক্তিশালী ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং ঋণ ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা- এসব মিলেই বাংলাদেশ দাতাদের আস্থা অর্জন করেছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দশকের মধ্যে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের ঋণ ৫০০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
১৯৯২ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ঋণ দিয়েছিল ৪ বিলিয়ন ডলারেরও কম। ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যা ছিল প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। এরপার গত ১০ বছরে সেই ঋণ ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
বর্তমানে বাংলাদেশের চলমান উন্নয়ন প্রকল্পে সংস্থাটির অর্থায়ন প্রায় ১৪ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। আর স্বাধীনতার পর থেকে মোট ৩৫ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে, যা অন্য উন্নয়ন সহযোগী বা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে অনুদান, সুদহীন ঋণ এবং সবচেয়ে কম সুদের ঋণ রয়েছে।
সংস্থাটির বাংলাদেশ কার্যালয়ের সিনিয়র এক্সটার্নাল অফিসার মেহরিন এ মাহবুব বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাংলাদেশ অনেক দিন ধরেই বিশ্ব ব্যাংকের সবচেয়ে কম সুদের ঋণ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্টেন্ট (আইডিএ) কর্মসূচির একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ঋণ গ্রহণকারী দেশ। এবং এই বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পারফরমেন্স কিন্তু খুব ভালো।
“বিশ্ব ব্যাংকের এ খাত থেকে এত বিপুল ঋণ নেওয়ার পরও বাংলাদেশ কোনও দিন কোনও কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়নি।”
বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির মৌলভিত্তি এবং এর ব্যবস্থাপনা ‘খুব ভালো’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “রিজার্ভও একটা ভালো অবস্থানে আছে। সবমিলে বাংলাদেশের পারফরমেন্স খুব ভালো।
“বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে দারিদ্র্য হার কমানো। গত এক দশকে দারিদ্র্য হার রেকর্ড পরিমাণ কমেছে। এবং কোভিড-১৯ মহামারীর প্রভাব থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর গতিও খুব ভালো।“
“এমনকি হিসাব অনুযায়ী ২০২০ এর তুলনায় ২০২১ সালেও বাংলাদেশের দারিদ্র্য হার সামান্য হলেও কমেছে, বাড়ে নাই। এগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী দিক,” যোগ করেন তিনি।
এ দেশের অর্থনীতির এভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার পেছনে তার সংস্থার মূল্যবান অংশীদারিত্ব রয়েছে বলেও মনে করিয়ে দেন তিনি।
এসময় শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক দুঃসময়ে বিশ্ব ব্যাংক কিছু করছে কি না জানতে চাইলে মেহরিন বলেন, “আসলে দুই দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। শ্রীলঙ্কা উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় তারা বিশ্ব ব্যাংকের সবচেয়ে কম সুদের ঋণ পায় না। যে সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েছে, তা শ্রীলঙ্কা পায়নি।”
দেশটিকে সহযোগিতার করার জন্য আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশের ঋণ ও দায় কী বেশি?
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে নেওয়া ঋণের মধ্যে উন্নয়ন সহযোগী ও দেশ বাংলাদেশের কাছ থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট পাবে ৫৫ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা।
বকেয়া এ ঋণ বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের জিডিপির আকার প্রায় ৪১৬ বিলিয়ন ডলার।
ইআরডির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত সব উন্নয়ন সহযোগী ও দেশ মিলে খাদ্য, পণ্য এবং প্রকল্প সহায়তা মিলে মোট ১৬ হাজার ১২৮ কোটি ডলার বা ১৬১ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দেয়। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ১৩৬ কোটি ডলার বা ১০১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ছাড় করেছে।
ছাড় করা অর্থের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৬ শতাংশ বিশ্ব ব্যাংকের। এরপর এডিবি পাবে ২৩ শতাংশ, জাপান ১৮ শতাংশ এবং চীন পাবে ৮ শতাংশ। এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়া, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) এবং আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিলের (ইফাদ) ঋণের পরিমাণ ১ শতাংশ করে।
শঙ্কা কতটুকু?
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক দুর্দশায় পড়া শ্রীলঙ্কার বিষয়টি সামনে এলে বাংলাদেশের ঋণ নিয়েও কথাবার্তা শুরু হয়। নীতি নির্ধারকরাও সরকারের অবস্থান সুষ্পষ্ট করে বলছেন, ভয়ের কিছু নেই। দুই দেশের মধ্যে তুলনা হওয়ার সুযোগই নেই।
এ বিষয়ক এক পর্যালোচনা সভায় তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ ঝুঁকি সীমার নিচে থাকায় অর্থায়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে নির্দেশনা দেন।
১২ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে জানানো হয়, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় কোনো ঝুঁকির আশংকা নেই। প্রায় সকল সূচকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে।
ওই দিনই ‘চলমান অর্থনীতি নিয়ে’ আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, বিদেশি ঋণের বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলেও বাংলাদেশের ঋণের একটি কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ জানিয়ে তিনি বলেন, “এ অনুপাত শ্রীলঙ্কার প্রায় ৪৮ শতাংশ। শ্রীলঙ্কা যে ঋণটা করেছে বিদেশ থেকে তার সুদের হার হল গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর আমরা যে বিদেশ থেকে ঋণ এনেছি তার সুদের হার হল ১ দশমিক ৪ শতাংশ।
“এ সমস্ত জিনিস থেকে বলতে চাচ্ছি যে আমাদের সামষ্ঠিক অর্থনীতির যে অবস্থা সেটার সাথে আমরা শ্রীলংকা বা পাকিস্তান কারও সাথে তুলনা করতে চাই না। আমরা মনে করি আমরা নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলছি।”
অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেনও মনে করেন বাংলাদেশের বৈশ্বিক ঋণ এখনও আশঙ্কা বা এর কাছাকাছি যায়নি।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান এ অর্থনীতিবিদ ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর এক সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওই প্রতিবেদনে উন্নত দেশের জন্য জিডিপির বিপরীতে ঋণহার ৯০ শতাংশ এবং উন্নয়নশীল দেশের জন্য এ হার ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত হলেও আশঙ্কা তৈরি করে না। এর ওপরে গেলে আশঙ্কা তৈরি হয়।
“আন্তর্জাতিক ঋণদানকারী সংস্থাগুলো এমন হিসাব করে ঋণ দেয় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর যেন ওই প্রকল্পের আয় থেকে যেন ওই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারে। অথবা প্রকল্পটি যেন জাতীয় আয় বাড়াতে পারে।“
ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, প্রকল্পটি যদি নিজেই ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা তৈরি করতে না পারে তাহলে ওই ঋণ জাতীয় অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করবে।
“এভাবে কয়েকটি মেগা প্রকল্প যদি যথা সময়ে শেষ করতে না পারে বা ঋণ পরিশোধের রেয়াতকালের মধ্যে শেষ করতে না পারে, তাহলে সেগুলো জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল চাপ তৈরি করতে পারে।“
তবে সাম্প্রতিক সময়ে নেওয়া বেশ কিছু মেগা প্রকল্প নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হওয়ার কথা জানান তিনি। উদাহরণ হিসেবে বলেন, “রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে এখনও কোনো রিটার্ন আসা শুরু হয়নি। কিন্তু প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। আগামী অর্থবছর থেকে ওই প্রকল্পের দ্বিতীয় ফেজের ঋণেরও কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
“লাখো কোটি টাকার ওই প্রকল্পের কিস্তিও কয়েক কোটি ডলারের হবে। তাই প্রকল্পটি যথাসময়ে শেষ করতে না পারলে এটি দেশের জাতীয় অর্থনীতির একটি মাথার ব্যাথার কারণ হয়ে উঠতে পারে।“
এসময় শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গে দেশটির জিডিপির বিপরীতে ঋণহার প্রায় ১১০ শতাংশ উল্লেখ করে জাহিদ হোসেন বলেন, “এক সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বার্থে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে সেগুলো থেকে রিটার্ন না আসায় ঋণ পরিশোধের দায় গিয়ে পড়েছে জাতীয় অর্থনীতিতে।”
শ্রীলঙ্কা নিয়ে বর্তমান আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিদেশি ঋণকে ভয় না পেয়ে সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শ এসেছে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের কাছ থেকে।
তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জিডিপির সঙ্গে বিদেশি ঋণের তুলনার পক্ষে নন। যুক্তি হিসেবে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কারণ আমাদের জিডিপি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের জিডিপির মত কাজ করছে না।
“যেমন প্রতিবেশী ভারত প্রতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণ করে জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ, পাকিস্তানে এ হার প্রায় ১৮ শতাংশ। এমনকি আফ্রিকার দেশগুলোও গড়ে ২০ শতাংশ রাজস্ব আহরণ করে। অথচ বাংলাদেশ রাজস্ব আহরণ করতে পারে জিডিপির তুলনায় মাত্র ১০ শতাংশেরও কম।“
বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আইএমএফের সাবেক ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা মনে করেন বাংলাদেশের আরও বেশি ঋণ নেওয়া প্রয়োজন।
তিনি বলেন, ২০২৬ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হব। এরপর যোগ্যতা দিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে জায়গা করে নিতে হবে। তাই ব্যাপকভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে। সে হিসাবে আমাদের আরও বিপুল ঋণের প্রয়োজন হবে।
“এখনও আমাদের অনেকগুলো মেগা প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামীতে আরও অনেক বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়ন করে যোগাযোগ অবকাঠামোসহ বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।“
এসব কারণে তিনি বিদেশি ঋণ নিয়ে শক্তিশালী অবকাঠামো গড়ে তোলার তাগিদ দেন। তবে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ নিয়ে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে ফায়দা নেওয়ার পরামর্শ তার।
সূত্র : বিডিনিউজ