যেভাবে জাফরুল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে গেলেন

সুপ্রভাত ডেস্ক »

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় একজন প্রবাদপুরুষ হয়ে থাকবেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। বাংলার মানুষের জন্য জাফরুল্লাহর সেবার ব্রত শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের জন্মক্ষণেই। খবর টিবিএসের। ১৯৪১ সালের ২৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ও পৈত্রিক নিবাস। বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন। পিতামাতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিক্যালে।

ছাত্র ইউনিয়নের মেডিক্যাল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্রাবস্থায়ই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন।

ছাত্রজীবনে চড়তেন দামি গাড়িতে। ছিল পাইলটের লাইসেন্স। লন্ডনে পড়াশোনাকালীন সময়ে রাজকীয় দর্জি তার বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করতেন বলে অতিরিক্ত পরিশোধ করতেন ২০ পাউন্ড। অথচ সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী এ মহান চিকিৎসক পরে একেবারেই সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। দেশে-বিদেশে কোথাও তার একটি ফ্ল্যাট পর্যন্ত নেই। বোনকে দান করে দিয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া জমিজমা। মরণোত্তর দেহদান করায় দাফনের জন্যও প্রয়োজন হবে না জমির।

১৯৭১ সালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী ৩০ বছরের যুবক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে যে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন তাদের একজন ডা. চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তার কালজয়ী সৃষ্টি ‘একাত্তরের দিনগুলি’র ১৬১-১৬২ পৃষ্ঠায় ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন- ‘চেনা হয়ে উঠেছে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডা. এমএ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফআরসিএস পড়ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙা খাটুনির পর যখন এফআরসিএস পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিলো, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করলো, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসলো। উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইন্স-এর। দামাস্কাসে পাঁচ ঘণ্টা প্লেন লেট, সবযাত্রী নেমেছে। ওরা দুইজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামেনি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল ওই দুইজন ‘পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে’ গ্রেফতার করার জন্য।

প্লেনের মধ্য থেকে কাউকে গ্রেফতার করা যায় না, কারণ প্লেন হলো ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুইজনকে জানিয়েছিল- ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘণ্টা লেট। এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়েছে।’

মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পর প্রাথমিক পর্যায়ে ডা. জাফরুল্লাহ গেরিলাযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে হতাহত যোদ্ধা, উদ্বাস্তু ও নির্যাতনের শিকার অসংখ্য নর-নারীর জরুরি চিকিৎসাসেবায় প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় একটি হাসপাতালের।

মুক্তিযুদ্ধের ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মোবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডা. সিতারা বেগম, বীরপ্রতীক। সেসময় প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টারটি হামলার শিকার হয়েছিল তাতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

স্বাধীনতার পরপরই দেশের স্বাস্থ্যখাতে নিজের কর্মযজ্ঞ শুরু করেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবার করুণ পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন জাফরুল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল ১৯৭২ সালের শেষ রোববার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের নামের পেছনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জড়িয়ে সুন্দর একটা গল্প আছে। ফিল্ড হাসপাতালকে স্বাধীন দেশে নতুন করে শুরু করার সময় তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার এটির নাম নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিল। বিরক্ত জাফরুল্লাহ সচিবালয়ে গিয়ে সোজা বঙ্গবন্ধুর কাছে নালিশ জানান, ‘মুজিব ভাই, ফিল্ড হাসপাতাল করতে দিচ্ছে না আমাদেরকে।’ বঙ্গবন্ধু তখন তাকে বুঝিয়ে বলেন, ফিল্ড হাসপাতালের সঙ্গে বাংলাদেশ শব্দটা থাকলে মনে হয় এটা বুঝি সরকারি হাসপাতাল।

হাসপাতালের জন্য সুন্দর একটা নাম দেওয়ার প্রস্তাব করেন বঙ্গবন্ধু। অনেক আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু প্রস্তাব দেন, তিনি তিনটা নাম ঠিক করবেন, আর জাফরুল্লাহ তিনটা নাম ঠিক করবে। সবচেয়ে ভালোটাই হবে হাসপাতালের নাম। পরের সাক্ষাতে নিজের তালিকা থেকে নাম পড়া শুরু করেন জাফরুল্লাহ। দুই নাম্বারে ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, এ নামটা সুন্দর। এটাই হবে হাসপাতালের নাম।

শুধু নাম দিয়েই ক্ষান্ত হননি বঙ্গবন্ধু, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য সরকারিভাবে ২৩ একর জায়গার বরাদ্দও দিয়েছিলেন। আরও কয়েকজন ব্যক্তি ও পারিবারিক সম্পত্তি থেকে মোট পাঁচ একর জায়গা দান করেছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের জন্য।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের দাপ্তরিক কাজ হয় বাংলাভাষা ও বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। বাংলাদেশের পাবলিক হেলথ সার্ভিসের এই আইকন সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক পান ১৯৭৭ সালে পদকটি প্রবর্তনের বছরে। বিকল্প নোবেল খ্যাত রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে। এ ছাড়া ১৯৭৪ সালে সুইডিশ ইয়ুথ পিস প্রাইজ, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, ১৯৯২ সালে সুইডেনের লাইভ লাই হুড পুরস্কার, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইন্টারন্যাশনাল পাবলিক হেলথ হিরোজ’ পুরস্কার লাভ করেন।