মেঘ বৃষ্টি ও মানুষ

রোকন রেজা :

বর্ষাকালে মাঠে পানি জমলে কাদা খোঁচাপাখি যেমন পাছা উঁচু করে মাছ ধরে, ঠিক সেই রকম যদু মিস্ত্রির বউ মাটির বারান্দার এককোণে আলোক চুলাতে ফুঁ পাড়ছে। কিন্তু চুলা জ¦লছে না। ধোঁয়া হচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও সে যখন চুলা জ¦ালাতে পারলো না তখন কাঠের পিড়ায় সোজা হয়ে বসে আঁচলটা গোছাতে গোছাতে বলে, তুমাক কয়েলাম কিচু কিচু ট্যাকা জমাও। ঘরডার এ্যাট্টা ছাওনি দ্যাও। তকুন দিলে না, এ্যাকুন সামলাও!

যদু মিস্ত্রি চৌকাঠে বসেছিল। কথা শুনে তার গা জ¦লে যায়, মাগী বলে কি ট্যাকা জমাও! কয় ট্যাকা হাইজরে পায় যে জমাবো! যা পায় তা দি প্যাট চালাতিই জান যায়! মাগী আবার কয় ট্যাকা জমাও!

কথাগুলো মিস্ত্রি বলে না। মনে মনে আওড়ায়। কিছুক্ষণ সে দম ধরে থাকে। ঘরের চালের দিকে তাকায়। জায়গায় জায়গায় সে পলিথিনের ব্যাগ গুঁজে দিয়েছিল। সেগুলোর পাশ দিয়ে এখন পানি পড়ছে। সেদিকে তাকিয়েই সে বলে, এক-দেড় শ ট্যাকায় কি কিচু হয়! ক, তুই-ই ক, হয় কিচু? হয় না। তারপর আবার তিনদিন ধইরে বাদলা। কাজ-কাম বন্ধ। রোকি ধানগুলানও শুকাতি পারচে না। রোইদ নেই। ধানগুলানও বুঝি নষ্ট হয়! সেদ্ধ ধান!

কথাগুলো বলে মিস্ত্রি আবার চুপচাপ হয়ে যায়। উদাস বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ওঠে দাঁড়ায়। বাতায় ঝুলানো জামার পকেট থেকে দুটো বিড়ি বের করে আবার চৌকাঠে এসে বসে। একটা ঠোঁটে ধরে। একটা লুঙ্গির ওপর রেখে বউয়ের দিকে তাকায়।

বউ আবার পাখির মতো ফুঁ পাড়ছে। স্বামীর দিকে তাকাতেই দেখে বিড়ি মুখে মিস্ত্রি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। কথা না বলে সে মিস্ত্রির দিকে দেয়াশলাইয়ের বাস্কটা ছুড়ে মারে।

মিস্ত্রি বিড়ি ধরায়। একগাল ধোঁয়া বের করে শুকনো গলায় বলে, শুনচি এই কষ্টের মদ্যিউ নাকি আরু একজন আসচে!

কথাটা বলে মিস্ত্রি আবার চুপ হয়ে যায়। কিন্তু ঐ কথাতে বউয়ের রাগ পানি। একটু লজ্জা পায়। যেন অপরাধটা তারই। ফুঁ পাড়া বন্ধ করে পাতিলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন পাতিলের ঢাকনায় সে আগত সন্তানের ছায়া দেখে।

যদু মিস্ত্রি যোগালে। ইট, বালু, চুন-সুরকি এসব টেনে দেয়। সিমেন্ট-বালি এক সঙ্গে মেশায়। দেয়ালে পানি দেয়, ইট ভেজায়। তবে যোগালে হলেও সবাই তাকে মিস্ত্রি ডাকে। লাভের মধ্যে এইটাই। কেরানি হলেও স্কুলের ছাত্ররা যেমন ‘স্যার’ ডাকে সেই রকম।

ছেলেটা আর এই কাজে আসেনি। চালের ব্যবসা। ধান কিনে চাল করে বিক্রি করে হাটে হাটে। তাছাড়া রোকি জানে রাজার ছেলে যেমন রাজা হয়, যোগালের ছেলেও তেমন যোগালে হয়। মিস্ত্রি হয় না।

রোকি এখন তার দাদার ঘরের এককোণে বন্ধুদের সঙ্গে জটলা পাকিয়ে তাস খেলছে আর বিড়ি টানছে। বিড়ি না, বোধহয় গাঁজা টানছে। মিস্ত্রি এখান থেকে গন্ধ পাচ্ছে। গাঁজার গন্ধ মারাতœক। ভাজা ইলিশ মাছের মতো। মিস্ত্রি সেদিন বলেছিল, দ্যাক, বিড়ে আমু খাই। বিড়ে খাতি তোক মানা করচিনে। কিন্তু গ্যাঁজা খাসনে। ও বড়ো খারাপ জিনিস। নিশা ধরে। লোকে খারাপ কয়।

উত্তরে রোকি মিসকি হেসে বলেছিল, গ্যাঁজা কি আমি প্রতিদিন খাই? খাইনে। বাদলার দিনি খাই। বাদলার দিনি এই জিনসির এ্যাট্টা অন্যরকম স্বাদ পাওয়া যায়। বিশে^স না করো ছকুরে জিঞ্জেস করে দ্যাকো!

সত্যিই ছেলেটা ইদানিং কেমন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। বাপের সঙ্গে রসিকতা করে। মিস্ত্রি আর কোনো কথা বলেনি। সে এখন তার মতো চলা ধরেছে। নিজের ইনকাম, নিজের স্বাধীনতা।

ছেলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মিস্ত্রি আকাশের দিকে তাকায়। ধোঁয়াটে আকাশ দেখে, ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দেখে। তারপর যেন সে আরও বেশি উদাস হয়ে যায়। কত-শত ভাবনা মনের মধ্যে এসে জমা হতে থাকে। আগত সন্তানের ভাবনা। আলোক চুলায় উবু হয়ে বসে থাকা বউয়ের ভাবনা। ঘরের ফুটো হয়ে যাওয়া চালের ভাবনা- আরও কত কি!। তারপর এক সময় নিচের দিকে তাকিয়ে সে দেখে, মন্টুর দাদি মাথায় ছেঁড়া গামছা ফেলে রোয়াকের দিকে ছুটে আসছে। সে বউয়ের কাছে গিয়ে মাথা থেকে গামছা নামিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলে, বউ-এ্যাট্টা খ্যাতা দে, আর কুপিত যোদ ত্যাল থাকে তালি কুপিডাও দে।

একটু থেমে একটা বড় নিশ^াস টেনে সে বলে, মরার কারেন- মরেচে!

ক্যানে কি হয়েচে? বউ প্রশ্ন করে।

মুবারকের বৌ’র ব্যাতা উটেচে।

এ্যাঁ-হটাৎ!

হটাৎ-ই।

হোসনেবু কি আয়েচে?

সে তো ককুনই আয়েচে।

কাইলকেও দ্যাকলাম গোলাপীবু পুকুর পাড়ে একগাদা কাপুড় ধোচ্ছে। এই যকুন অবস্তা তকুন কাজ করন কি ঠিক? আম কলামউ যে এ্যাকুন তুমার কাজ করন ঠিক না। আমার কতা শুনে তুমার বউ আবার মিচকি মিচকি হাসে। হাইসে হাইসে সে আবার কি বোলে শুনবা? বোলে- কতো বিয়োলাম!

একটু থেমে সে আবার বলে, কিন্তুক চাচী শুকনো খ্যাতা তো নেই। এ্যাট্টা ছিল। উডাই তো রমজান মুতে থুয়েচে।

তারপর চাচীর ভেজা কপালের দিকে তাকিয়ে সে বলে, ধাড়ী ছেলে তাও মুতা গেলো না। বাদলায় শুকাতি পারচিনে। আর কুপিত ত্যালউ ইট্টু ছিল- সকালতি আঁকায় ধুমো- উতি দি দিইচি।

মন্টুর দাদির মুখটা বিষাদ হয়ে যায়, কিচুই যকুন নেই মাগী আগে বোলবে তো!

এরই মধ্যে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে আসে। বাতাসেরও। মন্টুর দাদি ফিরে যেতে গিয়ে দেখে যদু মিস্ত্রির বৃদ্ধ বাপ ঘরের বারান্দায় ঊরু অব্দি লুঙ্গি তুলে প্রকৃতির সাথে একাতœ হয়েছে।

মন্টুর দাদি থমকে দাঁড়ায়। সামনে দিয়ে যাবে কি না দ্বিধায় পড়ে যায়। কিন্তু বৃদ্ধের কোনো ভাবান্তর ঘটে না। সে নির্বিঘেœ কাজ চালিয়ে যায়। মন্টুর দাদি একটু থেমে মাথায় গামছাটা আর একটু বাড়িয়ে দিয়ে পানির মধ্যে থপ থপ শব্দ করে সামনে দিয়েই চলে যায়।

যদু মিস্ত্রি বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে আনমনে বসে থাকে। তার উঠোন দিয়ে এখন ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টির ঘোলা জল। সেই জলে ভেসে যাচ্ছে বাঁশের পাতা, সজনের পাতা, কদমের পাতা, ফুল-পাপড়ি। ভেসে যাচ্ছে তার বাপের হলুদ মূত্র। মুবারকের বৌ’র পেট নিষ্কাষিত বর্জ্য রক্ত।

এতক্ষণ মিস্ত্রি ভেসে যাওয়া একটা বিড়ির শেষাংশে একদৃষ্টিতে চেয়েছিল। বিড়িটা যতই এগুচ্ছিল তার দৃষ্টিও সঙ্গে সঙ্গে এগুচ্ছিল। তারপর হঠাৎই একটা হিমহিম বাতাস এসে ঘূর্ণি মেরে যায় মিস্ত্রির কলকব্জায়। একটু কেঁপে ওঠে সে। বউয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডাকে, কুসুম ইট্টু শুনবা?

কি?

কাচে আসো।

দেকচো না রানচি!

আলোক চুলোই সবসুমাই না বসলিউ চলে।

কি বুলবা?

আসোই না!

মাটির মালসায় পানি পড়ার টপটপ শব্দ। দুটো টিকটিকি কুয়াড়ের ওপর রতি সঙ্গমে ব্যস্ত। ভেজা দুটো শালিক দূরের কদম গাছে চুপচাপ। বাড়ির পেছনে বাঁশবাগানে বিরহী একটা ঘুঘুর একটানা নিঃসঙ্গ কামাতুর ডাক। ঠিক তখনই বাতাসের একটা বেপরোয়া ঝাপটা। মিস্ত্রি আর লাগাম টানতে পারে না। বিড়িটাতে লম্বা টান মেরে উঠোনের পানিতে ছুঁড়ে ফেলে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা বউকে জাপটে ধরে।

ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। বিদ্যুতের আলোয় মিস্ত্রি দেখে তার ছোটো ছেলে রমজান ঘুম থেকে ওঠে চৌকির ওপর চুপচাপ বসে বসে বিস্মিত চোখে বাপ-মা’র তামাশা দেখছে।