মুক্তিযোদ্ধা ‘ট্রান্সফরমার’ মাহফুজের’ আড্ডা

বইমেলা

নিজস্ব প্রতিবেদক »

১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যাঁদের হার না মানা প্রত্যয়ে আজকের এই বাংলাদেশ, তাঁরাই বাঙালির অভিভাবক। জাতির প্রতিটি সুন্দর কর্মযজ্ঞের প্রধান যোগী যেন তাঁরাই। এবারের চট্টগ্রামের অমর একুশে বইমেলায় রয়েছে জাতির অভিভাবক সেই মুক্তিসংগ্রামীদের অংশগ্রহণে ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধ কর্নার। যেখানে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র ট্রাস্ট চট্টগ্রামের আয়োজনে থাকছে ‘মুক্তিযোদ্ধার আড্ডা’।

আড্ডায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ‘ট্রান্সফরমার মাহফুজ’ খ্যাত ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘আমরা সব মিলিয়ে প্রায় ৪০০টা অপারেশন করেছি। যদি আপামর জনগণ আমাদের সহযোগিতা না করতো, তাহলে এটা কি সম্ভব হতো? তাঁরা আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন, সংবাদ যোগাড় করে দিয়েছেন, মাছ-মাংস, শাকসবজি দিয়ে খাইয়েছেন।’

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান আরও বলেন, ‘ধরুন, কারো বাড়ির সামনে একটা ট্রান্সফরমার ওড়াবো। তো উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোঁয়ার বাড়ির সামনে মাইরজুমদে, তোঁয়ারার অসুবিদে ন অইবু?’

ওরা বলেছেন, ‘ওইলি আঁর অইবু, অনরত্তে কি?’ তারপর আমাদের একটা বড় অপারেশন ছিল আগ্রাবাদ হোটেলে। সেখানে দারোয়ান খবর দিচ্ছে, এইটা এই সময় গেলে ওড়াই দিতে পারবেন। আবার ইউসিসি লাইব্রেরিতে একটা আমেরিকান প্রতিনিধিদল আসবে। সেই সময়টাসহ বিস্তারিত তথ্য জানালো ওখানকারই একজন কর্মচারী। আমাদের এসব হামলার উদ্দেশ্য মানুষ মারা না। বিশ্বকে দেখানো যে, পূর্ব পাকিস্তান ভালো নেই। এ কাজগুলো গেরিলারা শহরে না শুধু, গ্রামে গঞ্জেও করেছে। হয়তো কোথাও একটা পাকিস্তানি ক্যাম্প আছে, সেখানে মুক্তিবাহিনী একটা গুলি ছুড়লো। এরপর ওই ক্যাম্পে থেকে ওরা সারারাত গুলি ছুড়ে গেল। এই যে আতংক ওদের মধ্যে জাগল, এটার কারণেই ওরা রেস্টিট করতে পারে নাই। এসব সাইকোলজিক্যাল খেলা গেরিলারা খেলেছে। প্রতিপক্ষের মনোবল ভাঙার আক্রমণই যুদ্ধের প্রধান হামলা, যা যুদ্ধ জেতায়।’
যুদ্ধের প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘রাজাকারেরা যুদ্ধের সময় বাড়িতে থাকতো না। সন্ধ্যায় বের হতো সকালে আসতো। তখন মুক্তিযোদ্ধারা মিররসরাইয়ের একটা বাড়িতে আশ্রয় নিল। সকালে রাজাকারেরা বাড়ি ফেরার আগে তাদের বউ বলে দিত, ‘ইতারা আইবু, এহন তোঁয়ারা যওগোই।’ যারা অগ্নিসংযোগ করেছে, লুটপাত করেছে কেবল তারাই রাজাকার। অনেক শান্তিবাহিনীর চেয়ারম্যান, অনেক রাজাকার কমান্ডার মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পুরোপুরি সহযোগিতা করেছেন। অর্থাৎ কিছু রাজাকারও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এটা মূলত গণযুদ্ধ ছিল। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা আসলে এসব আপামর জনগণই। আমাদের ট্রাস্টের মাধ্যমে আমরা এসব সত্যকে তুলে আনার চেষ্টা করছি। যেগুলো আমরা সহজে স্বীকার করতে চাই না, আমাদের ক্রেডিট কমে যাবে বলে।’

আড্ডায় আরও অংশ নেন ট্রাস্টের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীগণ। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শীগণ এসে তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন। সেসব বর্ণনাকে সাজিয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর জবানীতে ক্যামেরাবন্দি করা হচ্ছে। এসব তথ্যসংগ্রহ করা হবে ট্রাস্টের অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেলে। এসব তথ্য সংকলিত বই প্রকাশিত হবে ট্রাস্টের উদ্যোগে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক ট্রাস্টের আছে ১৫টি বই। ছোটদের ইতিহাস সচেতন করতে তাদের জন্য থাকছে ট্রাস্টের উদ্যোগে প্রকাশিত বিশেষ বই। ট্রাস্টের সদস্যরা মিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে ‘সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের’ দাবি নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন।

ট্রাস্টের কর্মকা- সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধা জাহেদ আহম্মদ বলেন, ‘১৯৮০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত কাজ করে আমরা একটা বই বের করেছি। অনেক সময়ের প্রয়োজন হয় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা সম্বলিত বই প্রকাশ করতে। আমরা জানি, এখনকার প্রজন্ম ইতিহাস নিয়ে অনেক কনফিউজড আছে। আমরা তাদের জন্য তথ্য সংগ্রহ করে একত্র করছি। আগামী ১০০ বছর পর যখন আমাদের সংগ্রহকৃত তথ্য-উপাত্ত সম্বলিত বইগুলো নিয়ে নিরপেক্ষ গবেষণা হবে, তখনই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে। তবে এখন বিভ্রান্ত হওয়ার প্রচুর সুযোগ আছে।’