হাফিজ রশিদ খান »
সেকালের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে গত বিশ শতকের ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদ এবং ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের সর্বমোট ৩১৩টির মধ্যে ১৬৭ আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০ আসনের মধ্যে ২৯৮টিতে জয়লাভ করে। ৬ দফা এবং ১১ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হয়। এই প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ’ এবং ‘জয়বাংলা’ এ দুটি সেøাগান প্রথম ব্যবহার করেন। রাজনীতিবিজ্ঞানী রওনক জাহানের ভাষায় : ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনের এই বিশাল সাফল্যের পর থেকেই আমরা বিপুল আশা-উদ্দীপনার মধ্যে ছিলাম। বাংলাদেশ যে সৃষ্টি হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে আর কোনো সন্দেহ ছিল না। তখন একমাত্র প্রশ্ন ছিল, আমরা কি শান্তিপূর্ণভাবে আলোচনার মাধ্যমে এই স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করতে পারব, নাকি আমাদের একটা বিরাট রক্তাক্ত সংঘাতের পথে যেতে হবে। আমার মনে পড়ে, ১ মার্চ যখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত করলেন এবং তারপর যখন বঙ্গবন্ধু ৩ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষই তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় Ñ সবাই পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করল। পৃথিবীর আর কোনো দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট দেশটির জাতীয় স্বাধীনতা স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত প্রশাসনকে এভাবে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করতে দেখা যায়নি। এর একটি প্রধান কারণ হলো, বঙ্গবন্ধু আহুত অসহযোগ আন্দোলন এমনই ব্যাপক ও সর্বজনগ্রাহ্য ব্যাপার হয়ে পড়েছিল যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সচল রাখার প্রয়োজনে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালেই বঙ্গবন্ধুকেই সারাদেশের শাসনভার পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়।
সূত্র : বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারা। প্রথম আলো, ১০ জুলাই ২০১৯।
এর পরবর্তী ইতিহাস হলো, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তথা আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানি শাসকবর্গ। তারা সময়ক্ষেপণের আড়ালে সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং একই প্রক্রিয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট নামে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। অনিবার্যভাবেই তাৎক্ষণিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ওই হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে বাঙালিরাও। শুরু হলো নয় মাসব্যাপী মুক্তযুদ্ধ। এই সশস্ত্র লড়াইয়ের পর স্বাধীনতা এলো। স্বৈরাচারী শোষণ-বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে এদেশের সকল পথে ও প্রান্তরে উড়লো নতুন মানচিত্রখচিত লাল-সবুজের পতাকা। সুজলা-সুফলা হরিৎ জনপদের স্মারক ওই সবুজের পটভূমে লালবৃত্তটি তিরিশ লক্ষ শহীদের আত্মদান ও দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর প্রতীকরূপে স্থাপিত হলো। পাকিস্তান নামক ঔপনিবেশিক কারাগারকে সদম্ভে পদদলিত করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ রাষ্ট্র শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, সারাবিশ্বের নিপীড়িত-লাঞ্ছিত মানুষের চেতনার ঘরে এক নতুন, উজ্জ্বল বলিষ্ঠ অভ্যুদয়ের নাম। পবিত্র বাইবেলের লাজারাস চরিত্রের মতো শিরদাঁড়া শক্ত করে ওঠে দাঁড়ানো এদেশের সংখ্যাহীন তামাটে প্রতিরোধযোদ্ধারা প্রতারক রাষ্ট্রের প্রতিমূর্তি ভেঙে চুরমার করে দিল। চির অবহেলিত, চির কোণঠাসা আর চিরদিন দাবিয়ে রাখতে চাওয়া এই মানুষেরা একটি বজ্র কণ্ঠস্বরের কোনো দৈববাণী নয়, নিখাদ দেশজভাষার ডাকে জেগে উঠলো, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা’য়। গত শতকের উনিশ শ একাত্তর সালের পঁচিশ মার্চ কালরাতের পর ওই বজ্রকণ্ঠের সংকাশে জীবনবাজি রেখে সর্বাত্মক প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলে বাংলার পাললিক ভূগর্ভে সঞ্চার হলো নতুন এক শক্তিমন্ত ভ্রƒণের। যে-ভ্রƒণ মানেনি প্রচল কোনো নিয়মের নিগড়। সকল বাধা পেরিয়ে, রক্তসাগর সাঁতরে ওই ভ্রƒণ এদেশের পাহাড় ও সমতলের বুকে রেখেছে তার অক্ষয় আগমনী পদচিহ্ন। পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনী ও তাদের দোসরদের লোলুপ মুখমণ্ডলে এঁকে দিয়েছে সে দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ থাবার বীভৎস নখরাঘাত। পরাস্ত, মৃত, পরধনলোভী হায়েনাদের সমাধি রচনা করে সেই ভ্রƒণই আজ বিশ্ববিশ্রুত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। সেই বাংলাদেশ এখন প্রতিযোগিতাবহুল বিশ^মাঠের ক্রীড়াঙ্গনে ব্যাঘ্রসম ক্ষিপ্রগতি, নতুনরূপের উন্নয়ন ধারণায় উদ্বুদ্ধ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সূচকে আগুয়ান, স্বদেশজাত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রতি সহমর্মী ও দায়বদ্ধ, ধর্মীয় সহনশীলতার ভারসাম্যপূর্ণ প্রেক্ষাপট রচনায় আন্তরিক, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিশ্বমান সমুন্নত রেখে বিচার সম্পাদনকারী, শিক্ষা-সংস্কৃতি-সাহিত্য ও শিল্পকলায় মাটি ও মানুষের অমর অবয়ব সৃজন-নির্মাণে সংকল্পবদ্ধ। সেই বাংলাদেশই এখন এগিয়ে চলেছে বিশ্ব অভিমুখে। ওই শক্তিমন্ত ভ্রƒণের পূর্ণ বিকশিত রূপকল্পের স্বপ্নদর্শনই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা।
এই চেতনার ইতিহাসের পথ বেয়েই এসেছে সংযুক্তির দৃঢ় মেলবন্ধন গড়ে তোলার অনিবার্য তাগিদ। এই সংযুক্তি নকশিকাঁথায় সুচ চালনার মতো রাতজাগা অনুরাগ, প্রীতি ও প্রেমের প্রস্ফুটিত ফোঁড়ের পর ফোঁড়, রূপময় বাংলাদেশের ভাবষ্যতের অবয়ব। এই চেতনাপথ রেলের বগির মতো লৌহগিঁঠে সচল জীবনের বহু দূরগামী সঞ্চরণের আশাজাগানো শব্দ। এই চেতনাপথই মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তসুন্দরের জয়গান ধরে রাখে জারি-সারি-ভাটিয়ালি-মাইজভাণ্ডারী তরিকা ও গীতভান্ডারের ছায়াতলে। এই চেতনাপথ দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করে রাখে পূর্ববঙ্গ গীতিকা, গাজীকালু চম্পাবতী, আমিনা সোন্দরী, আদিবাসী পৌরাণিক আখ্যান রাধামন-ধনপুদি, মনরি-মাংৎসুমুই’র গণমনরঞ্জনী কাহিনি-গাথার চিরায়ত নান্দনিকতা। এই চেতনার ভেতরে উজ্জ্বল সংবেদনাময় মানবিকবোধে জেগে থাকেন চর্যাপদের ধ্যানী ও দূরবীক্ষণশালী ঋষি-সন্তানেরা, বৈষ্ণব সহজিয়া মার্গের সুন্দর প্রহরীরা। সুফি-আউলিয়া-পির-মুরশিদের লৌকিক-পারলৌকিক আনন্দ-বেদনার পথরেখা এই চেতনার অভ্যন্তরেই মেলে মুক্তোর ছড়ানো দানার মতো। এখানেই নয়নে মায়াঞ্জন মেখে জেগে থাকেন লালন-হাছন-কানাই-রমেশ শীল-জালাল উদ্দীন খাঁ-গফুর হালী ও সৈয়দ মহিউদ্দিনের শ্রমময় আধ্যাত্মিক ও লোকায়ত বিধুর সুরের মানবমুখী প্রশান্ত উচ্চারণমালা। এ যেন আসকর আলী পণ্ডিত, উকিল মুন্সী, শাহ আবদুল করিমের কাক্সিক্ষত সর্বধর্ম সমন্বয়ী প্রার্থনার ‘বারামখানা’। এ যেন চিরায়ত সেই বন্দনাগীতি :
পূবেতে বন্দনা করলাম পূবের ভানুশ্বর।
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশর ॥
দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষীর নদী সাগর।
যেখানে বানিজ্জি করে চান্দ সদাগর ॥
উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস র্পবত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথ্থর ॥
পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা হেন স্থান।
র্উদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান ॥
সভা কইর্যা বইছ ভাইরে ইন্দু-মুসলমান।
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম ॥
চাইর কুনা র্পিথিমি গো বইন্ধা মন করলাম স্থির।
সুন্দরবন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর ॥
আসমানে-জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সূরুয।
আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব কুরান ॥
কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি।
উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি॥
সূত্র : পূর্ব্ববঙ্গ গীতিকা; পৃ. ৪৫, দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত
এ তো অবিসংবাদিতভাবে সত্য যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উদ্বোধন হয়েছে পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সময়েই, সেই উনিশ শ সত্তর সালের নির্বাচনী প্রচারণায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুখনিঃসৃত শব্দযুগল ‘বাংলাদেশ’ আর ‘জয়বাংলা’র ভেতর দিয়ে। আর তার বিপুল প্রসার ঘটেছে দুশমন দলনের মাঠে, গেরিলাদের সশস্ত্র হামলা আর তারপরের ভৈরবী বিজয় হরষের ইতিহাসমালায়। নয় মাসের শত্রুধ্বংসী শৌর্যবীর্যে, অপরিমেয় সম্পদ ও লোকক্ষয়ের বেদনার্ত, শোকার্ত এবং সর্বশেষ বিজয়ের উল্লাসের গাথায় রচিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সুপরিসর মহা মঙ্গলকাব্যটি। এ কাব্যের প্রধান নায়ক বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক-দার্শনিক-স্থপতি বলে অপার সম্মানে-শ্রদ্ধায় এদেশের আপামর জনতা তাঁকে ডেকেছে ‘জাতির পিতা’ বলে। এই সাম্মানিক সম্বোধনের প্রতিষ্ঠায় লাগে না কোনো ফরমান বা এত্তেলা বা গেজেট নোটিফিকেশন। এ অনর্গল স্রোতের মতো স্বতঃস্ফূর্ত, স্বয়ম্ভূ গরিমায় এর উদ্ভাসন। এই সম্বোধনে মন্দ্রিত হয় তৃণলতা ও বৃক্ষসমূহের পত্রালি, স্রোতোস্বিনীর শান্ত গতরে জাগে গতির গর্বিত চঞ্চলতা। আকাশজুড়ে বিহার করে রঙধনুর সপ্তরঙা আনন্দ। ওই পূত-পবিত্র নামে বাংলাদেশ পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছে বিশ্বসভার অষ্টমহলা। তিনিই গৌরবের স্বরে প্রাণছোঁয়া বাংলা ভাষায় জগতের কানে পৌঁছে দিয়েছেন বাহান্নের ভাষা শহীদদের আত্মার স্পন্দন, জাতিসংঘের সদর মোকামে।
উনিশ শ পঁচাত্তর সালের পনেরো আগস্ট শালপ্রাংশু জাতির পিতার দরদি ও মরমি দেহ স্তব্ধ হয়ে গেল কুলাঙ্গার, মীরজাফরী প্রেতাত্মা, অবিমৃশ্যকারী ঘাতকের বুলেটে। বীরপ্রসবিনী বাংলাদেশ ক্ষণকাল স্বজনহারানোর দৈন্যে শোকবিহ্বলা হলো বটে, তবে থেমে গেল না জাতির পিতার চেতনা ও তাঁর মুখনিঃসৃত সেই অমেয়বাণীর ধাবমান ধৈবত থেকে। শত-সহস্র ধারায় তা আরও ছড়িয়ে গেল বাংলাদেশের মহীন মৃত্তিকায়, আকাশের-বাতাসের অণু-পরমাণুতে। চারপাশের নদী-সমুদ্র, হাওর-বিল-ঝিলে, পাহাড়ের ভাঁজে-ভাঁজে সেই ক্রন্দন আঁসু আনে নয়নে-নয়নে। আর তাঁর আত্মস্বীকৃত, ধিক্কৃত হীনঘাতকেরা নিজ পাপের প্রায়শ্চিত্তে চিরনির্বাসিত হলো বাংলার মাটি থেকে।
কেউ-কেউ বিচারের রায়ে ঝুলে গেল ফাঁসির রজ্জুতে। জাতির পিতার প্রাণের আলোর বিচ্ছুরণে জেগে আছেন তাঁর সংশপ্তককন্যা, বঙ্গ-বসুন্ধরার বিশাল কৃতীমুখ, মাতৃময়ী দেশরত্ন, রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তাঁর বাচনে, তাঁর সংসক্ত চলনে, তাঁর উজ্জ্বল-উদ্ধার মননে আর তাঁর প্রদীপ্ত অনুসারী-অনুরাগী সৈনিকদের বুকে-বুকে জাগে চেতনার যে অনির্বাণ দীপশিখা, সেই তো মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গহন অঞ্চল। চেতনার এই অভিসন্দর্ভে সুগ্রথিত হয়ে আছে বাংলাদেশ ও বাঙালির বিশ্বপরিসর পর্যটন ও গৌরবের বিহার। সাম্য-মৈত্রী ও কল্যাণব্রতের বীজমন্ত্র এখানেই রয়েছে নিহিত।
এই চেতনার অভিসন্দর্ভের বিদগ্ধ দর্পণে প্রস্ফুটিত হয় প্রত্নবাংলার মানসবিভা। চিরায়ত-লোকায়ত বাঙালির আয়ুষ্মান সন্তানদের কাব্যকথা, শিল্প ও সৌন্দর্যের রঙদার ক্যানভাস। এখানে একাঙ্গ হয়ে জড়িয়ে আছে এখন ও আগামীর সোনার বাংলার সমৃদ্ধ জনপদ ও তার অজস্র কনকদ্যুতি ছিটানো সিংহতোরণ। এই চৈতন্যের দার্শনিক শেকড় হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালিকে একসুতোয় গেঁথে রাখে সকল বৈষম্যের উৎপাটনে। বাঙালিকে এ সংস্থাপন করে মানবতার চিরকালীন কুলীন রাজদরবারে। এখানে নিরন্তর উৎসারিত হয় সুকৃতির ফোয়ারা, পাতালে সমূলে প্রথিত হয় সকল দুরাচার ও দুর্যোধন। এই চেতনার অভিপ্রায়ে বাঙালি যাবে সত্য অথচ প্রিয়বাক্যের সোনালি সংবর্ধনার দিঘল মজলিশে। ভাষা ও শিক্ষা, চারু ও কারু, কাব্য ও কথা, জীবনের বহুমুখী সৃজন ও নির্মাণের নিপাট স্বর্গরাজ্যে। বিপরীতে এই চেতনাগর্ভের দারুণ বহ্নিশখা ভস্ম করে দেবে মানবতার অবমাননা, জঙ্গিপনা ও সন্ত্রাস-মাদকের কালো যবনিকাসমূহ। এভাবেই এখানে বসত করে সুশোভনা বাংলাদেশ, কবি নজরুলের ভাষায় :
একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী-জননী।
ফুলে ও ফসলে কাদামাটি জলে ঝলমল করে লাবনি ॥
রৌদ্রতপ্ত বৈশাখে তুমি চাতকের সাথে চাহ জল,
আম-কাঁঠালের মধুর গন্ধে জ্যৈষ্ঠে মাতাও তরুতল।
ঝঞ্ঝার সাথে প্রান্তরে-মাঠে কভু খেল ল’য়ে অশনি ॥
কেতকী-কদম-যূথিকা কুসুমে বর্ষায় গাঁথ মালিকা,
পথে অবিরল ছিটাইয়া জল খেল চঞ্চল বালিকা।
তড়াগে-পুকুরে থই থই করে শ্যামল শোভায় নবনী ॥
শাপলা-শালুক সাজাইয়া সাজি শরতে শিশির নাহিয়া,
শিউলি-ছোপানো শাড়ি পরে ফের আগমনী-গীত গাহিয়া।
অঘ্রানে মা গো আমন ধানের সুঘ্রাণে ভরে অবনি ॥
শীতের শূন্য মাঠে তুমি ফের উদাসী বাউল সাথে মা,
ভাটিয়ালি গাও মাঝিদের সাথে কীর্তন শোনো রাতে মা।
ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবিরে রাঙাও নিখিল ধরণী ॥