আলহাজ্ব এস এম ইসমাইল »
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইতিহাসের পাতায় আপন মহিমায় ভাস্বর একটি নাম। বঙ্গবন্ধু অভিধায় ভূষিত হবার আগে কৈশোরে, যৌবনে, সহপাঠী, সমবয়সী ও আত্মীয়দের কাছে তিনি ছিলেন মিঞা ভাই। পরিবারের সবার কাছে ছিলেন খোকা। ১৯৫০ এর দশকে রাজনৈতিক সহকর্মীদের ভাষায় ছিলেন নেতা, লিডার। এভাবে ধাপে ধাপে তিনি ১৯৬৯-এ আগরতলা মামলার পর কারামুক্তি শেষে হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু, জাতির জনক।
১৯৬০ এর দশকে আমি কানুনগোপাড়া স্যার আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় থেকে অন্যান্য লক্ষ লক্ষ বাঙালি ছাত্র-যুবকদের মতো তিনি হয়ে ওঠেন আমারও নেতা। ১৯৬৯ সনে সিটি কলেজে কমার্সে ডিগ্রির ছাত্র থাকাকালে প্রবল রাজনৈতিক আন্দোলনের তরঙ্গে মিছিলে লক্ষ-লক্ষ ছাত্র-ছাত্রীর মতো ভেসেছি আমিও। ঐ সময়ে সিটি কলেজকে (চট্টগ্রাম) বলা হত ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের দুর্গ। সে সময় আমরা চট্টগ্রাম এর সাবেক সিটি মেয়র জননেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সাংসদ কফিল উদ্দিন চৌধুরী, আবদুর রউফ খালেদ প্রমুখের মতো তেজস্বী ছাত্রদেরকে দেখেছি নেতা হিসেবে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিরোধী আন্দোলনের পুরো সময়টাতে সিটি কলেজ সর্বদা টগবগ করতো। আমাদের রাজনৈতিক সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম আবর্তিত হতো একটি নামকে কেন্দ্র করে। সেই নাম – শেখ মুজিব ।
১৯৬৯ এর পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এলো নতুন গতিপথ। দল হিসেবে মুসলিম লীগ সাংগঠনিক নেতৃত্ব ও আদর্শিক অবক্ষয়গ্রস্ত। পুরোনো ইতিহাসের জাবর কাটা শিথিল লোলচর্ম বিশিষ্ট সাংগঠনিক অবয়ব ও জরাগ্রস্ত অস্তিত্ববিশিষ্ট এই দল এমনকি সামরিক স্বৈরশাসকদেরও আস্থা হারায়। গণতন্ত্রের বীজ বোনার নতুন মৌসুম আসে রাজনীতির চরে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে অনাবাদী চরের প্রধান চাষী। ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর এর অবাধ নির্বাচনের ফসল উঠলো আওয়ামী লীগের নৌকায়। বাংলার মানুষ নতুন আশা ও স্বপ্নে বুক বাঁধলো। রইলো বাঙালির নিজস্ব সরকার ও প্রশাসনের আগমনের আশায়। চলল অনেক তালবাহানা। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের অন্ধকারে পরিপূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল তৎকালীন পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাওয়া হলো তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে। কড়া প্রহরায় রাখা হলো কারা অভ্যন্তরে।
এদিকে সবুজ শ্যামল নদীবিধৌত বাংলাদেশের ¯িœগ্ধ মাটি তেতে ওঠে জনগণের প্রতিরোধের আগুনে। শুরু হল প্রতিরোধের লড়াই ও গেরিলা যুদ্ধ। জীবন মরণ সংঘাত। এ মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়ি, গ্রাম, মহল্লা হয়ে ওঠে এক একটি সেনা নিবাস। নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসী, ছাত্র, শ্রমিক, জনতা তখন নিজেরাই যোদ্ধা, নিজেরাই নেতা, নিজেরাই সৈনিক, ক্ষেত্র বিশেষে নিজেরাই সেনাপতি। তারাই রণকৌশল স্থির করেন। এই মহান জনযুদ্ধের ফলশ্রুতিতে গোটা বাংলাদেশ পরিণত হলো এক বিশাল রণক্ষেত্রে।
আমরা এবং আমাদের মতো যারা তখন বয়সে টগবগে তরুণ, তারা প্রকৃত প্রস্তাবে বলতে গেলে প্রাণটা হাতে নিয়েই দিবারাত্রে বনেবাদাড়ে, পাহাড়ে, গুহায় খানা-খন্দকে রাইফেল গ্রেনেড হাতে নিয়ে হানাদার সেনা ও তাদের বেঈমান সহযোগী রাজাকার আলবদরসহ সকল বৈরী শক্তির মোকাবেলায় দৃঢ়সংকল্প। জীবন মরণ হয়ে পড়ে তুচ্ছ। দিনের প্রথম প্রহরের পর থেকে আসর পর্যন্ত হায়েনাদের হিং¯্র পদচারণা থাকলেও মাগরিব থেকে ফজরের আযান পর্যন্ত পুরো সময়টা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তথা বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, নারী, পুরুষ জনতার। অস্ত্র সরবরাহ, খাদ্য সরবরাহ, গোপন ঘাঁটিতে আসা-যাওয়া, টার্গেট সন্ধান ও গেরিলা হামলা সব চলে রাত্রির ছায়ায়। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ হানাদাররা রণে ভঙ্গ দিল ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু সগৌরবে বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। শুরু হলো আরেক নতুন সংগ্রাম। দেশ গড়ার সংগ্রাম। ছাত্র জীবনে সিটি কলেজে ছাত্রাবস্থায় যেমন ছিলাম, ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধকালে যেমন ছিলাম, তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশে দেশ গড়ার সংগ্রামে নামলাম বঙ্গবন্ধুরই নেতৃত্বে। এই কর্মযজ্ঞ আরেক ব্যাপক বিষয়। এই কর্মযুদ্ধ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও জটিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সেই অভিজ্ঞতাও অর্জনের সৌভাগ্য হলো। এবার শুরু হলো মানুষের সাথে মিশে মানুষের সাথে কর্মযুদ্ধ। নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু। আমরা হুকুম তামিলকারী।
তাঁর নেতৃত্বে কাজ করার গতিশীলতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং সাফল্যের তৃপ্তি অর্জনের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। একদিকে নিজের পেশাগত চাকুরি এবং এর পাশাপাশি দেশ ও দশের জন্য কাজ করার অভিজ্ঞতা আমাকে দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্ব। জীবিকার জন্য শ্রম দিতাম পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে। আর অবশিষ্ট সবটুকু সময় উজাড় করে দিতাম দেশ ও দলের খেদমতে। ছাত্র রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে ওঠায় সুযোগ হলো দলীয় রাজনীতিতে নামবার।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে উত্থান হলো ও নিজের উপজেলা বোয়ালখালীর পোপাদিয়া ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান হলাম ১৯৭৪ সালে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির শ্রমিক ও অফিসার স্তরের সংগঠনে নেতৃত্বদান, ১৯৯২ সাল থেকে টানা দেড় দশক হাওলা কুতুবিয়া মাদ্রাসার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দ্বীনি খেদমত আঞ্জাম দেবার তৌফিক আল্লাহ্ আমাকে দিয়েছেন। কৈশোরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে যাত্রা শুরু করেছিলাম জীবনের অপরাহ্নেও আমার সেই যাত্রা অব্যাহত। যে হাত দিয়ে যৌবনে বোয়ালখালীতে নিজ গ্রামে আওয়ামী লীগ সংগঠন তৈরি ও পরিচালনা করেছিলাম, আজও তার পরিচিতির আকর্ষণ আমাকে নিবিড়ভাবে টানে।
আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি ও সঞ্চয় বঙ্গবন্ধুর উষ্ণ সাহচর্য লাভ। আমি সেজন্য এখনো নিজেকে ধন্য ও তৃপ্ত মনে করি। মনে পড়ে ১৯৬৯ সালের মার্চের তৃতীয় সপ্তাহের কোন এক দিনের কথা। চট্টল শার্দুল এমএ আজিজ বোয়ালখালী থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর একটি বাণীর জন্য আমাকে ঢাকা পাঠিয়েছিলেন। বাণীর খসড়া লিখে দিয়েছিলেন এমএ আজিজ। ভীরু ভীরু পায়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাই। কম্পাউন্ডে ঢুকে দেখি তিনি ঘরের বাইরে একটি বেঞ্চে বসে আছেন। তিনি আমাকে খসড়াটা পাঠ করতে বললেন। তিনি শুনলেন এবং সই করে দিলেন। তাঁর সই করা বাণীটি নিয়ে আমি এমএ আজিজ সাহেবের হাতে দিই।
আরেক দিনের কথা। ১৯৬৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে এলেন গুরুত্বপূর্ণ দলীয় সাংগঠনিক কাজে, উঠলেন চট্টগ্রাম জিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এমআর সিদ্দিকীর বাসায়। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। বৈঠক বসলো বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খানের বাটালী পাহাড়স্থিত বাড়িতে। এ কে খান ছিলেন এমআর সিদ্দিকীর শ্বশুর। আলোচনা চলছিলো তখনকার আজিজ ও জহুর সাহেবের দ্বন্দ্বের অবসানকল্পে। দীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন- আজিজ-জহুর তোমরা আমার ভাই। আজ রাতের মধ্যে তোমরা এক হয়ে যাও। পত্রিকায় বিবৃতি দাও। তা নাহলে আমি আমার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করবো। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় কণ্ঠের আওয়াজে বৈঠকস্থলে নীরবতা নেমে আসে। আজিজ-জহুর দ্বন্দ্ব এক বৈঠকেই ঘুচে যায়। পত্রিকায় বিবৃতি প্রকাশিত হলো। দল প্রবল উৎসাহে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশক্রমে রাজনীতির মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
১৯৭৫ সালের প্রথমার্ধে বাকশাল গঠনের পর গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষাৎ করতে যান চট্টগ্রামের প্রথম সারির আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাঁশখালী আওয়ামী লীগ নেতা জাকেরুল হক চৌধুরী, আনোয়ারা আওয়ামী লীগ নেতা আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ও আতাউর রহমান খান কায়সার। এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সাথে গণভবনে বঙ্গবন্ধুকে দর্শন করার সৌভাগ্য আমারও হয়েছিল ।
আজ জীবনের অপরাহ্ন বেলায় আরো মনে পড়ে আমার অগ্রজ নেতা ডা. এমএ মান্নান, জানে আলম দোভাষ, এসআর ফারুকীসহ সবাইকে যাদের সাথে হেঁটে সংগ্রামবহুল কঠিন সময়ে আমার প্রাণপ্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগের পতাকা বহন করেছি। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ বাস্তবায়ন করেছি সকল অবস্থায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার চট্টগ্রাম সফর উপলক্ষে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী হিসেবে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বিভিন্ন সভায় যোগ দেবার সুযোগও হয়েছে আমার।
জীবনসায়াহ্নে আওয়ামী লীগের রাজনীতি, বঙ্গবন্ধুর মহান স্মৃতি, দলীয় সহকর্মীদের কর্মময় অন্তরঙ্গ দিনগুলোর স্মৃতি ঝলমল করে ওঠে চোখের পর্দায়। এগুলো আমার ক্ষুদ্র জীবনের পরম পাওয়া। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উপলক্ষে আমার এই স্মৃতিটুকু নিবেদন করলাম।
লেখক: প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা,
প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক, পোপাদিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ ও প্রাক্তন চেয়ারম্যান,
৬ নং পোপাদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম