মান্দাসা

তাপস চক্রবর্তী »

তরণী দাশের বৃদ্ধ মা গীতারাণী। ‘তিন মাথাওয়ালা মানুষ’ প্রবাদবাক্যটি একমাত্র গীতারাণীর বেলায় শতভাগ প্রযোজ্য। নব্বই বছরের বৃদ্ধ মহিলা। চুল শাদা ধবধবে। শরীরে চামড়াগুলো খুলে আসতে চায়। হাঁটতে পারে না। চোখেও দেখে না তেমন। কোন রকম লাঠিতে ভর দিয়ে চলে।

আজ সকালে থেকেই তাঁর নাতনিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ভগ্নশরীর নিয়ে পাড়ায় তল্লাশি শুরু করলো। এবাড়ি-ওবাড়ি গিয়ে শুধু চাঁপী ও চাঁপী… করে ডাকছে। ক্ষীণ শব্দ কারো কানে যায়, আবার কারো কানে যায় না। যে শোনে সে বলে, চাঁপী আজ এ পথ মাড়ায়নি। আবার কেউ টিপ্পুনি কেটে বলে, দেখো তোমার নাতনি হয়তো কোনো নাগর পেয়েছে …

তবুও ক্ষীণকণ্ঠে গীতা রাণী ডেকে-ডেকে হয়রান, চাঁপী-চাঁপী ও … বৃদ্ধার ক্ষীণ আওয়াজটা মিলিয়ে যেতেই একটা দোয়েল পাখি নড়েচড়ে বসলো ভেরেন্ডা গাছের মগডালে। তারপর টুপ করে একটা গুবরে পোকার ওপর আক্রমণ করলো। অসহায় গুবরে দোয়েলের খাদ্য হতে সেকেন্ড সময় নেয়নি। জীবন এমন!

চাঁপার মেদহীন শরীরখানা ধীরে ধীরে দিনের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কি যেন মগ্নতায় আজ চেপে বসেছে! পা দু’খানা ছড়িয়ে মাটিতে বসে বসে… সবুজে ঘেরা গেঁয়ো আলোয় অমবস্যা যেমন আলোর খেলা করে কিম্বা কৈশোরে পা রাখা ছেলেটি যেমন বুকে জমা রাখে কিছু নির্জনতাÑ তেমন।

চাঁপা একা দাঁড়িয়ে আছে পিছনে সকালের আলোকিত সূর্য। সম্মুখে জীর্ণ দিঘি। উত্তরে মরাগাছ ফেলে ঘাটের মতো কিছু একটা বানানোর চেষ্টা।

খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে চাঁপা। হাসলে মনে হয়, হাসিতে মুক্তো ঝরে ওর। দোলনফুলের পাপড়ি খসাতে খসাতে একসময় বলে ওঠে, চাঁপা। আমি-ই চাঁপা। ওই যে খালের পাড়ে যে একচালা টিনের ঘর। ওটা আমাদের বাড়ি। খালে জাল টেনে বাবা সংসার চালায়। কোনো রকম টেনেটুনে। অনেকটা ছেঁড়াজালের মতো। আমার রূপ দেখে আপনারা ভিরমি খচ্ছেন? আমার মাও খেয়েছিল। কিন্তু বাবা! আমার গায়ের রং দেখে নাম রেখেছিলেন চাঁপা। আর সেই চাঁপাটা কখন যে চাঁপী হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারিনি।

চাঁপার পাথরের মতো স্থির চোখ জোড়া। ক্রমশ চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে ওঠে। একসময় শ্রাবণের মতোই চোখের কোটর হতে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।

আজ পঞ্চমী। পঞ্চমীর চাঁদটা আজ সবেমাত্র মাঝ আকাশে। অনেকটা নিশ্চুপ পৃথিবী। মাঝে মাঝে নীরবতা ভেঙে যায় ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দে। ভেজামাটির ঘ্রাণ ভেসে আসে। রাতের আঁধারে কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে, কয়েকজন প্রতিবেশী পালবাড়ির ভাঙা মন্দিরে ধোয়া-মোছার কাজ করছে।

সামনে শরৎ। অকালবোধনের উৎসব হয় পালবাড়ির উঠোনে। চরের গুচ্ছ গুচ্ছ কাশের বনে নীলকণ্ঠ পাখির আনাগোনা বেড়ে গেছে। শিমের মাচায় বসে সমস্বরে ডাকছে পিউ পিউ। কুটুমপাখির লাল ঠোঁটে যেন বিরহের সম্মিলন। ঝরা শিউলিফুলে মাটির বুক শুভ্র, নির্মল হয়ে উঠেছে। প্রকৃতি সেজেছে অপার মহিমায়।

অথচ আজকের সকালটা ঘোষদের জন্য একটু অন্যরকম। কোনো সাজ নেই। শুধু বিষাদের বীণা বেজে গেছে দূর বহুদূর পর্যন্ত। ইদানিং অবনী পালের ভিটেতে যেন শনির দশা লেগে থাকে। সেই পার্টিশান থেকে শুরু … এটা যেন নিয়তির পয়গাম।

ঝিঁঝির ডাক মাড়িয়ে অনেকগুলো হ্যারিকেনের আলো দেখা যায়। আলোগুলো রহিমুদ্দিনের ভিটের দিকে এগিয়ে আসছিল। অন্ধকারের বুক চিরে ক্রমশ হ্যারিকেনের আলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আবছা আলোয় কাউকে কাউকে চেনা যায়। আবার কারো মুখটা আঁধারে ঢেকে থাকে। দূর থেকে আলোগুলোকে অনেকটা জোনাকপোকার মতো ভেবে নিতে আপত্তি থাকে না।

রহিমুদ্দিনের বাড়ির উঠোনে একটা বিশাল মশালের আলো জ্বলছে। সে আলোয় ছোট একটা খাট বসানো। অনেকটা মঞ্চের মতো সাজানো। খাটের মাঝেখানে দাঁড়ানো রহিমুদ্দিন। প্রতিদিন পালাগান হয় ম-ল বাড়ির উঠোনে।

রহিমুদ্দিন মন্ডল নিজেই গায়েন। ছেলেবেলায় একবার গোবর্ধন গায়েনকে দেখেছিল আসরে। তখন ছিল শ্রাবণ মাস। অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। পাল পাড়ায় আয়োজন করেছিল চাঁদ সওদাগর আর পদ্মাবতী কেচ্ছা। রহিমুদ্দিন শুনেছিল। তখন কত বয়েস হবে! সেই থেকে রহিমুদ্দিনের স্বপ্ন, সে একদিন গায়েন হবে। খুউব নামকরা। দেশে-দশে সবাই তাকে চিনবে। তার স্বপ্নপূরণ হয়েছে। সে এখন প্রতিষ্ঠিত গায়েন। এক নামে সবাই তাকে চেনে। যদিও গান করা তার পেশা না। এটা তার নেশা।

অনেকবার রহিমুদ্দিনের আব্বা জালাল মাস্টার বড় আক্ষেপ করে রহিমুদ্দিনকে বলেছিল, কী হবে এসব করে?

রহিমুদ্দিন বাপের কথা শুনে একটা মুচকি হেসে বলেছিল, জানি বাপ, কিছুই হবে না। তবুও তো দিলখুশ হয়। জানো বাপজান, খোলের আওয়াজ শুনলে বুকের ভিতরে নাচন লাগে … আমার রক্ত কেমন জানি করে।

জালাল মাস্টার আর কিছুই বলেনি। শুধু পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। মনে মনে বিড়বিড় করে কি জানি বলল, রহিমুদ্দিন কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। তবে এটুকু ভেবেছিল, পিতা হিসাবে পুত্রের কাছে প্রত্যাশা যেন আশার বালুচর। আজ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে রহিমুদ্দিন। বয়সের ভার শরীরে। এদিকে রহিমুদ্দিনের পিতা জালাল মাস্টার কবরবাসী। তাও আজ পঞ্চাশ বছর গত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জালাল মাস্টার শহিদ হন। রহিমুদ্দিনও সেদিন পিতার সাথে ছিল। সেদিন রহিমুদ্দিন কোনোভাবে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন রহিমুদ্দিন পিতার লাশ কাঁধে নিতে পারেনি। কোনোভাবে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে।

মাঝে মাঝে রহিমুদ্দিন আপ মনে বিড়বিড় করে বলে, আব্বা ফিরে আসবে। দেশ পাল্টে যাবে .. সবাই শুধরে যাবে, দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে মান্দাসার চরের বালুতে লিখে রাখে, একদিন আব্বা ফিরে আসবে। মান্দাসার সবাই জানতো এসব লেখা রহিমুদ্দিনের। তার ক্ষোভকে সবাই শ্রদ্ধা করতো। বলতো একদিন না একদিন ওসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবে।

এক সময় খোল-করতাল বেজে ওঠে। আসরে মগ্ন রহিমুদ্দিন একসময় নেচে ওঠে। নাচ থামিয়ে জোড়হাতে গেয়ে উঠে রহিমুদ্দিন …

নদী ও সমুদ্রের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে ছিলÑ

একটি গ্রাম,

অথচ সেদিন বিবাহিত পুরুষ হয়ে ভেসে যাচ্ছিলাম

স্রোত ভেঙে ভেঙে কচুরিপনার মতো

দূরে বহুদূরে।

ঠিক তখনি কেউ তার মতো ডাকলো,

দেখলাম, চাঁদের আলোয় রূপসি জলের নৃত্য

চোখে চোখ লেগে গেল তরঙ্গ আর জল

বুকে বুক লেগে গেল রুপোলি জল।

তারপর গ্রামের নাম খুঁজলাম পাগলের মত

কেউ কেউ কানে কানে বললো, নদীর নাম কঙ্খÑ

গ্রামের নাম শঙ্খিনী

কেমন যেন খটকা লাগলো। বললাম, আজ থেকে তার নাম হোক ‘মান্দাসা’। মঞ্চের চারপাশে গোল করে বসা সবাই সমস্বরে বলে উঠলো, বাহ বাহ ।