অর্থনীতিবিদ ড. মঈনুল ইসলাম #
বাংলাদেশে গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে দেশে যেক’জন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন সময়ে সোচ্চার ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম। ২০০৮ সালে একুশে পদকপ্রাপ্ত এই অর্থনীতিবিদ সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে সবচেয়ে বেশি উৎসাহী ছিলেন। এখন সোনাদিয়ায় আর গভীর সমুদ্রবন্দর হচ্ছে না। সোনাদিয়ার ২৫ কিলোমিটার পশ্চিমে মাতারবাড়িতে হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। গভীর সমুদ্রবন্দর ঘিরে ভূ-রাজনীতি এবং দেশের উন্নয়ন নিয়ে সুপ্রভাতের সাথে কথা বলেছেন বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ।
সুপ্রভাত বাংলাদেশ: আপনি সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলেন। এখন তো আর সেখানে হচ্ছে না, মাতারবাড়িতে হচ্ছে। এতে কি সোনাদিয়ার ফল মিলবে?
ড. মঈনুল ইসলাম: সোনাদিয়ার সাথে কারো তুলনা হয় না। জাপানের স্টাডিতে এখানে একটি প্রাকৃতিক চ্যানেলের সন্ধান পাওয়া যায়। যেখানে ১৮ থেকে ২০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ সহজে ভিড়তে পারবে। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুর কারণে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্প থেকে সরে আসি আমরা। পরবর্তীতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত কৃত্রিম চ্যানেলকে কাজে লাগিয়ে গভীর সমুদ্র বন্দরের স্বাদ পূরণ করা হচ্ছে। তবে যেহেতু এটি কৃত্রিম চ্যানেল তাই ড্রেজিংসহ মেইনটেনেন্স খরচ বেশি হবে। সোনাদিয়ার চেয়ে মাতারবাড়ি খারাপ হবে না, তবে ড্রেজিং করতে হবে।
সুপ্রভাত: ভূ-রাজনৈতিক ইস্যু বলতে আপনি কী বোঝাতে চাচ্ছেন?
ড. মঈনুল ইসলাম : সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর করার জন্য জাইকার স্টাডির ভিত্তিতে চীনের অর্থায়ন করার কথা ছিল। কিন্তু এ নিয়ে প্রতিবেশি দেশের বিরোধিতার মুখে সরকার আর এগুতে পারেনি। পরবর্তীতে মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পে জাপান অর্থায়ন করার পর এই প্রকল্পের অধীনে কয়লা নিয়ে জাহাজ ভেড়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে বন্দর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা আলোচনায় আসে, পরবর্তীতে যা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর হিসেবে উত্থান হয়।
চীন চেয়েছিল সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন নির্মিত হবে। অপরদিকে মিয়ানমার প্রান্তেও রেললাইন নির্মিত হবে। এই রেললাইন মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত যুক্ত থাকবে, যাতে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে চীনের কুনমিং এলাকায় পণ্য নিয়ে যাওয়া যায়। পরবর্তীতে চায়না সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে না পেরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে এবং সেখান থেকে কুনমিং পর্যন্ত নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
বিপরীতে ভারতও মিয়ানমারের কালাদান বহুমুখী প্রকল্পে বিনিয়োগ করে। আর এই প্রকল্পের অধীনে বন্দরের সাথে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যে ছোটো জাহাজ নেয়ার জন্য একটি নৌ রুটও নির্মাণ করে। ফলে চীন ও ভারত উভয় রাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। আর এর প্রভাব আমরা দেখতে পাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে। দুই দেশই কিন্তু প্রকারান্তরে মিয়ানমারের পক্ষে। এদের কেউ মিয়ানমারের বিপক্ষে যাবে না। এসবই কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট।
সুপ্রভাত: তাহলে কি দোহাজারি থেকে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন হওয়ার সম্ভাবনা আর নেই?
ড. মঈনুল ইসলাম: ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ এর আওতায়। এখন আর এই রুটের গুরুত্ব নেই। মিয়ানমার প্রান্তে আর রেললাইন আপাতত হচ্ছে না। তবে মাতারবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপক উন্নয়ন হবে সন্দেহ নেই। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত এই এলাকায় শিল্পায়ন হবে। একইসাথে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর এবং আনোয়ারায় টানেলের প্রান্তে চীনের বিশেষ ইকোনমিক জোন হতে যাচ্ছে। মাতারবাড়ি বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, বে টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগর সব মিলিয়ে এই এলাকা বিশাল অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠবে। আর এর সুফল পাবে পুরো দেশ।
সুপ্রভাত: মাতারবাড়ি কি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ সুবিধা নিশ্চিত করবে?
ড. মঈনুল ইসলাম : বিশাখাপত্তমে ভারতের একটি গভীর সমুদ্রবন্দর রয়েছে। তাই সেই বন্দরের মাধ্যমে ভারত তাদের গভীর সমুদ্র বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। তবে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ মাতারবাড়ি বন্দরের মাধ্যমে তাদের পণ্য পরিবহনের সুযোগ নিতে পারে। সেক্ষেত্রে মাতারবাড়ি থেকে আঞ্চলিক সুবিধা নিতে পারে আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলো।
সুপ্রভাত: মাতারবাড়ির মাধ্যমে কি আঞ্চলিক উন্নয়ন সম্ভব?
ড. মঈনুল ইসলাম: চীন-ভারত বৈরিতা যতোদিন থাকবে ততোদিন আঞ্চলিক উন্নয়ন হবে না। তবে মাতারবাড়ির মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন হবে। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকায় একটি শিল্প বেল্ট গড়ে উঠবে।