আবার এলো রক্তরাঙা সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে একুশের অমন রক্তরক্তিম ছবিখানাই সর্বাগ্রে দৃষ্টিপটে ভেসে ওঠে। সেই ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে ঔপনিবেশিক পাকিস্তানি আমলে সূচিত মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই আজও কিশেষ হয়েছে? বাংলা কি পরিপূর্ণরূপে এদেশের মানুষের জীবিকার প্রধান ও একমাত্র ভাষা হয়ে উঠেছে? চারদিকে একটু খোলা চোখে নজর ফেললে বুঝতে পারি, আমাদের জীবিকার ভাষার জায়গায় যেন অন্য বা পরদেশি ভাষা বেশ বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে। সেটা ইংরেজি। নিঃসন্দেহে ইংরেজি যেকোনো বিচারে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কেজো ভাষাগুলোর অন্যতম। ইংরেজি ভাষা বা এ-ভাষার ঋদ্ধি ও তার সর্বব্যাপী কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের কোনো নিন্দা-মন্দ নেই। কারণ বিশ্বে প্রচলিত প্রত্যেক ভাষাই একই রকমের সমৃদ্ধ ইতিহাসও কার্যকারিতা ধারণ কে বেঁচে আছে বা বেঁচে থাকতে চায়। এভাবে জাপান চীন কোরিয়া প্রভৃতি দেশ তাদের নিজস্ব ভাষার ভিত্তি প্রথিত করেছে তাদের জনমানসের অত্যন্ত গভীরে। এবং পৃথিবীর বুকে নিজেদের অস্তিত্বের ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে সগৌরবে। তারা আন্তর্জাতিক ভাষাবাহনরূপে ইংরেজিকে শুধুমাত্র বহির্বাণিজ্যের খাতিরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে নিয়েছে। এবং স্বাজাত্যবোধ ও জাতীয় ধ্যান-ধ্যারণাকে বিশ্বভুবনে অতীব সাফল্যের সাথে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছে স্বদেশে নিজেদের ভাষার গরিমাকে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনও মূল চেতনাগত দিক থেকে একই রকম দাবিই উত্থাপন করেছিল। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা জুলুম-নির্যাতন ও গুলির মুখে প্রাণ দিয়ে সেই দাবির কথাই জাতির ভাবী নেতৃত্বকে জানান দিয়ে গিয়েছিলেন। বায়ান্নর সেই শক্তি ও দুর্বার বাসনাকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে বাংলা ভাষার সম্মানরক্ষার্থে প্রাণ আহুতি দেয়া বাঙালির সন্তানেরা ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন করেছিল। সেই থেকে বাংলাকে সর্বস্তরের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠ ও চালুকরণের নতুন লড়াইও শুরু হয় এবং আজও তা চলছে।
১৯৯৯ সালে জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়াতে আমাদের ভাষার লড়াইয়ের খবরও বিশ্বব্যাপী গভীরভারে প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার পেয়েছে। এই বাস্তবতায় আমাদের উচিত, উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি সকল কর্মক্ষেত্রের প্রত্যেক স্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার সুদৃঢ় করা। এ বিষয়ে সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের জন্য প্রণীত যে আইনটি প্রায় তামাদি হয়ে পড়ে আছে তার ভেতরে নতুনভাবে প্রাণসঞ্চার করা এবং বাধ্যবাধকতার সংস্কৃতি চালু করা। ঠিক যেভাবে নব্য শিল্পোনত রাষ্ট্রগুলো তাদের দেশীয় পরিসরে কাজটি সম্পন্ন করে দেশের বিপুল-অধিকাংশ মানুষকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত ও কর্মসম্পৃক্ত করে তুলতে পেরেছে।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলা একটি অতীব উন্নত ভাবপ্রকাশক ও জীবনের সব ধরনের অনুভূতি ধারণের উপযোগী বিশ্বের ৭ম ভাষা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রসূতির মর্যাদা পাওয়া, অতুল সম্ভাবনাময় বাংলা ভাষা আমাদের সকল রাষ্ট্রীয় অভ্যন্তরীণ কাজের অদ্বিতীয় ও অবশ্যম্ভাবী ভাষাবাহন হয়ে উঠুক। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি তথা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে এই আমাদের প্রদীপ্ত শপথ হোক