সুপ্রভাত ডেস্ক »
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়াসহ মশাবাহিত এসব রোগ নির্মূল করতে হলে মশানিধন করতে হবে। অন্যদিকে, বর্তমানে মশানিধনে যেসব কীটনাশক ছিটানো হচ্ছে সেগুলো কতটুকু কার্যকর তা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
বলা হচ্ছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই দেশে প্রয়োগ করা হচ্ছে এসব কীটনাশক। এদিকে প্রচলিত মশার কীটনাশকের সঙ্গে গেলো বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে পরীক্ষা করা হয় প্রাকৃতিক উপায়ে তৈরি ভেষজ মশার ওষুধও। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
‘মসকুবার’ নামে এই ভেষজ ওষুধ দেশে প্রচলিত অন্য কীটনাশককে পেছনে ঠেলে শতভাগ কার্যকর বলে ল্যাব পরীক্ষায় প্রমাণ হয়েছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ল্যাবে শতভাগ কার্যকর প্রমাণ হওয়ার পরও মশানিধনে এই ওষুধ রহস্যজনক কারণে প্রয়োগ করছে না দেশের কোনও সংস্থা। তবে এই ওষুধের আবিষ্কারক শ্যামল চৌধুরী ধর্না দিচ্ছেন বিভিন্ন সংস্থার কাছে—যাতে তার তৈরি মশার ওষুধ পরীক্ষামূলকভাবে হলেও প্রয়োগ করে যাচাই করে দেখে।
শ্যামল চৌধুরী বলেন, বর্তমানে দেশে ডেঙ্গু মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এছাড়া ম্যালেরিয়া, হলুদ জ্বর, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়াসিস, জিকা ভাইরাস এবং অন্যান্য আরও ভাইরাস রোগের বাহক মশা। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে নয়; দেশের আরও কয়েকটি ল্যাবেও মশানিধনে তৈরি এই ভেষজ ওষুধ শতভাগ কার্যকর। এই ওষুধ ব্যবহারে মশানিধনে শতভাগ সাফল্য আসবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মশা নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মশকনিধনের জন্য কার্যকর ওষুধ নিশ্চিতকরণে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটিকে ২০২১ সালে ৫টি কীটনাশকের নমুনা সরবরাহ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। এরমধ্যে রয়েছে এডান্টিসাইড এবং লার্ভিসাইড। গবেষণা টিম ওই সময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৯৯টি স্থান পরিদর্শন করে। এরমধ্যে নগরীর ৫১টি স্থান এবং চবি ক্যাম্পাসের ভেতর ও বাইরের আরও ৬টি স্থানসহ মোট ৫৭টি স্থান থেকে মশার লার্ভা সংগ্রহ করে। সংগ্রহকৃত কিছু সংখ্যক লার্ভা সংরক্ষণ শেষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে লালন-পালনের মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক মশায় রূপান্তর করা হয়। সরবরাহকৃত এডান্টিসাইড এবং একটি লার্ভিসাইড প্রাপ্তবয়স্ক মশা ও মশার লার্ভার প্রয়োগ করে কার্যকারিতা যাচাই করা হয়।
৫টি নমুনা ওষুধের মধ্যে ভেষজ উপায়ে তৈরি মসকুবার মশার ওষুধ লার্ভিসাইড এবং এডাল্টিসাইড দুটিতেই শতভাগ কার্যকর। লার্ভিসাইড স্প্রে পরীক্ষায় বাকি তিনটির একটিতে ১৬ শতাংশ, একটিতে ৮৪ শতাংশ এবং অপরটিতে শূন্য শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। তবে এডাল্টিসাইড স্প্রে পরীক্ষায় হারবাল ওষুধ শতভাগ কার্যকর হয়। অপর ওষুধের মধ্যে একটি ৩৪ শতাংশ, দুটি ৮ শতাংশ, একটি ১২ শতাংশ ও একটি ৩ শতাংশ কার্যকর বলে পরীক্ষায় উঠে আসে। তবে ফগিং মেশিনে মশার ওষুধ স্প্রে করলে সেটি তেমন কার্যকর নয় বলেও এই গবেষণায় দেখা যায়। এ গবেষণায় ফগিং মেশিনে ১৯ শতাংশের উপর কোনটিই কাজ করেনি।
গবেষণা টিমের আহ্বায়ক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া এবং সদস্য সচিব ছিলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক।
ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সরবরাহকৃত পাঁচটি কীটনাশক পরীক্ষায় ভেষজ উপায়ে তৈরি একটি মশার ওষুধ আমাদের গবেষণায় শতভাগ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। আমরা ওই ওষুধটি ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনকে পরামর্শ দিয়েছি। মশানিধনে কার্যকর ওষুধ ব্যবহার করা না হলে মশা মরবে না। তাই ওষুধ ছিটানোর আগে এসব ওষুধ পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ওই সময় আমরা বেশ কয়েকটি সুপারিশ করেছি। যার মধ্যে ছিল নির্দিষ্ট সময় পর পর কিংবা নতুন কীটনাশক কেনার পর অবশ্যই এর কার্যকারিতা যাচাই করা। রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে বিকল্প হিসেবে জৈব নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো চালু করা যেতে পারে। যেমন—মাছ চাষের মাধ্যমে লাভা নিয়ন্ত্রণ, অনুজীব ব্যবহার করে লাভা ধ্বংস করা, উদ্ভিদের নির্যাস ব্যবহার করে লার্ভা ধ্বংস করা, দীর্ঘদিন কীটনাশক ব্যবহারে মশা রেজিস্ট্যান্ট কিনা তা যাচাইয়ে মশার জিনগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে দেখা।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ভারপ্রাপ্ত পরিচ্ছন্নতা কর্মকর্তা আবুল হাশেম বলেন, পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহারের জন্য ১০০ লিটার মসকুবার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব মসকুবার প্রয়োগ করে দেখার পর পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমরা এগুলো প্রয়োগের কার্যকারিতা দেখে পরবর্তী উদ্যোগ নেবো।
এ প্রসঙ্গে মসকুবার ওষুধের আবিষ্কারক শ্যামল চৌধুরী বলেন, ‘ভেষজ উপায়ে তৈরি মশা নিধনের ওষুধ মসকুবার শতভাগ কার্যকর। তা শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবে নয়; অন্যান্য ল্যাবেও পরীক্ষায় এ তথ্য উঠে এসেছে। এটির স্প্রে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর নয়। তবে প্রচলিত স্প্রে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এই ওষুধের সঙ্গে ৫০ থেকে ৬০ গুণ পরিমাণ কেরোসিন, ডিজেল, ন্যাপথা বা অন্যান্য পাতলা খনিজ তেলের সঙ্গে মিশ্রিত করে প্রয়োগ করতে হয়। মশানিধনে ক্ষতিকর কীটনাশক ক্রমাগত ব্যবহারের ফলে রোগবাহী ভেক্টর প্রজাতির মশার দেহে ওইসব কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে উঠেছে। এ কারণে প্রচলিত কীটনাশক মশানিধনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।’ দেশে মশা নিধনে যেসব কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে সেগুলোর কার্যকারিতাও পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তিনি।