জোবায়ের রাজু »
ছয় ঘণ্টা আগে নন্দিতার কাছে ফেসবুকে যে-ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টটি এসেছে, সে আইডির নাম : দিপা আক্তার। নন্দিতা সাধারণত আননোন কাউকে বন্ধুতালিকায় জায়গা দেয় না। কিন্তু এই অচেনা দিপাকে অ্যাকসেপ্ট করার অন্যতম কারণ হচ্ছে তার ‘দিপা’ নামটি। এই নামে নন্দিতার এক সময় এক বান্ধবী ছিল, একেবারে ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। যে কিনা এলিফ্যান্ট রোডে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তের বছর আগে। সেই দিপাকে এখনও ভুলতে পারেনি নন্দিতা।
ফেসবুকে অচেনা দিপাকে অ্যাকসেপ্ট করার কিছুক্ষণ পর ওপার থেকে মেসেজ আসে।
নন্দিতা আপু, কেমন আছ? আমাকে চিনেছ?
না তো! কে না?
আমি দিপা। মধুপুরের দিপা। এবার চিনেছ?
ইয়ে মানে! না, চিনতে পারিনি।
হিহিহি। আমি আনোয়ারার মেয়ে। আপনারা যখন মফস্বলে থাকতেন, তখন আমার মা আপনাদের বাড়িতে কাজ করতো। মাঝে-মাঝে আমাকে নিয়ে যেত। আমি আর আপনি ছাদে খেলতাম। মনে আছে?
এবার সব মনে পড়ল নন্দিতার। তখন নোয়াখালীর গ্রামের বাড়িতে থাকত নন্দিতারা। মধুপুর গ্রামের সেই মফস্বলের বাড়িট ছিল নন্দিতার দাদার। সেই বাড়িতে রোজ সকালে কাজ করতে আসত আনোয়ারা নামের এক মহিলা, যার স্বামী ডাকাতদের হাতে খুন হন। পুতুলের মতো দেখতে একটা মেয়ে ছিল আনোয়ারার। নাম দিপা। মায়ের সাথে মাঝে-মাঝে দিপা আসতো নন্দিতাদের বাড়ি, দুজনে খেলতো। নন্দিতার পুরনো জামাগুলো দিয়ে দেয়া হতো তাকে। সারা বছর সেসব জামা পরে দিন চলে যেত দিপার। একদিন নন্দিতারা ঢাকা শহরে চলে যায় বাবার চাকরির কারণে। ওপার থেকে আবার মেসেজ আসে দিপার।
কি হল আপু, এবার চিনেছ?
হুঁ।
চিনতে তো হবেই। ছোটোবেলার খেলার সাথিকে কি কেউ ভোলে! একটা কথা বলি আপু?
কি?
ছেটোবেলায় তোমার পড়ার টেবিলের ড্রয়ার থেকে আমি তোমার একটা পুতুল চুরি করেছিলাম। তুমি হয়তো অনেক খুঁজেও পুতুলটি আর পাওনি। তাই না?
মনে পড়ছে না দিপা।
আচ্ছা দাঁড়াও। আমি ছবি তুলে পাঠাই।
কিছুক্ষণ পর মেসেন্জারে একটি পুতুলের ছবি পাঠায় দিপা। পুতুলের ছবি দেখে একেবারে নস্টালজিক হয়ে গেল নন্দিতা। কোনো এক বৈশাখী মেলা থেকে সেবার পুতুলটি নিয়েছিল সে। কিনে নয়, চুরি করে। সেই ছোট্ট দোকানে যখন অন্যেরা খেলনা কেনার দর কষাকষিতে দোকানির সঙ্গে মগ্ন, সুযোগ বুঝে নন্দিতা পুতুলটি সরিয়ে ফেলে। বাড়িতে এনে ড্রয়ারে ভরে রাখে। মাঝে-মাঝে রাতে বের করে দেখতো। একদিন দেখে ড্রয়ারে পুতুলটি নেই। হারিয়ে গেছে। আজ এতো বছর পর জানলো সেটা হারায়নি। চুরি করে নিয়ে গেছে দিপা। একজনের চুরি করা পুতুলটি চুরি করেছে আরেকজন। যেন প্রকৃতির এক অদ্ভুত প্রতিশোধ।
আবারও মেসেজ পাঠায় দিপা। মনে মনে বিরক্ত হয় নন্দিতা। সবেমাত্র বন্ধুর তালিকায় সংযুক্ত হল। আজই সব কথা বলে শেষ করতে হবে কেন! তাছাড়া নন্দিতা একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারো সাথে মেসেজ আদান-প্রদানে অতটা সক্রিয় না। তাই অনেকের লাগাতার মেসেজে সে অনেক সময় বিরক্ত হয়। যদিও তা প্রকাশ করে না।
আপু, তুমি বিয়ে করেছ?
না।
কি বলো, এখনও বিয়ে করোনি? বয়স কত চলছে এবার? কবে করবে তাহলে? আমার কিন্তু দুটো মেয়ে আছে।
ও আচ্ছা।
তো কারো সাথে সম্পর্ক আছে? মনে হয়, আছে। এত সুন্দর তুমি। কেউ না কেউ তো অবশ্যই মনের রানি বানিয়ে রেখেছে!
এবার সত্যি-সত্যি মেজাজ খারাপ হল নন্দিতার। এসব অসভ্যতার মানে কি! একদিনের আলোচনায় এত গভীর বিষয়ে জানতে চাওয়া অভদ্রতা। শিক্ষাদীক্ষা আছে তো মেয়েটার! থাকলে আর এমন অসভ্য আচরণ করতো না। মফস্বলের মেয়েরা আর কতটুকুই বা শিক্ষিত হবে!
বিয়ের চিন্তা আপাতত মাথায় নেই নন্দিতার। মাস্টার্স ফাইনালটা হয়ে গেলে শফিকের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার লক্ষ তার। তার আগে বিয়ে নয়। কিন্তু চারপাশের কানাকানি আর উদ্বিগ্নতা দেখে বিরক্ত নন্দিতা। আড়াল থেকে অনেক শুভাকাক্সক্ষীর ভং ধরা পরিচিতরা যে তাকে আইবুড়ি নামে তিরস্কার করে, সেটাও কানে আসে নন্দিতার। কিন্তু ওদের ওসব আঘাত দেয়া কথার প্রতিবাদ নয়, বরং নিজেকে উচ্চশিক্ষিত করে গড়ে তোলাই এখন তার লক্ষ। আর এসব কথা এখন ভাববার সময় নয়। ভার্চুয়াল জগতের এই দিপা নামের মেয়েটির এসব অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের কারণে কথাগুলো হঠাৎ ভাবনাতে এল নন্দিতার। আবার একটি মেসেজ লিখে পাঠায় দিপা।
আপু, তোমার প্রোফাইল ঘুরে এলাম। শত শত ছবি। এত ছবি তোলার সময় পাও কিভাবে? তবে সব ছবিতে তোমাকে নায়িকার মতন লাগছে।
আচ্ছা ধন্যবাদ।
আমার একটা আবদার রাখবে, আপু?
কি?
তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে না? তার ছবি দেখাও তো!
নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না নন্দিতা। এই মেয়ে জঘন্য টাইপের বেয়াদব। কেন যে অ্যাকসেপ্ট করতে গেলাম! কারো সাথে প্রথম পরিচয় হলে কিভাবে কথা বলতে হবে, জানা নেই এই মেয়ের- মনে মনে ভাবে নন্দিতা।
অনবরত মেসেজ লিখে পাঠাচ্ছে দিপা। নন্দিতা ইচ্ছে করেই জবাব দেয় না। ওপার থেকে নন্দিতার নীরবতা দেখে দিপা এবার ম্যাসেন্জারে কল দেয়। এতে করে রাগে-ক্ষোভে গা কাঁপতে থাকে নন্দিতার। লাইন কেটে দেয়। আবার কল দেয় দিপা। আবারও লাইন কেটে দেয়। এভাবে চলতে থাকে কতক্ষণ। কত বড় স্পর্ধা, এই মেয়ে অনুমতি ছাড়া কল দেয়!
শেষ কলটা আসার সাথে-সাথেই দিপাকে ব্লক করে দেয় নন্দিতা। এমন উজবুক মানুষকে সে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখবে না। তার বন্ধুর তালিকায় থাকবে মিথিলা, যার বাবা একজন ইঞ্জিনিয়ার। ফারিয়াও থাকবে, যে কিনা একজন ক্যাপ্টেনের মেয়ে, নর্থসাউথে পড়ে। নিশিকে তো রাখতেই হবে, নিশির দুই ভাই পাইলট, আর বাবা সাবেক কর্নেল। এসব ধনীর দুলালিদের নিয়ে ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগতে আড্ডা দিতে নন্দিতার আপত্তি নেই। এরাই থাকবে নন্দিতার ফ্রেন্ডলিস্টে। দিপা নামের মফস্বলের কোনো সাধারণ মেয়েকে ফ্রেন্ডলিস্টে রাখার মানে হয় না, যার মা ছিল এক সময় নন্দিতাদের বাড়ির কাজের বেটি। কাজের বেটির মেয়ে আর কতটুকুই-বা মার্জিত হবে, নন্দিতা তা ভালো করেই জানে।