৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ
‘বৃষ্টির পর সব খালের বাঁধ কেটে দেয়া হবে’
ভূঁইয়া নজরুল >>
বহদ্দারহাট মোড়ে গলা সমান পানি। ষোলশহর, মুরাদপুর, শুলকবহর, স্বজন সুপার মার্কেট, বহদ্দারহার বাড়িসহ আশপাশের এলাকায় কোমর থেকে গলা সমান পানিতে বন্দী নগরবাসী। রাস্তায় পানি জমে যাওয়ায় লালখান বাজার দিক থেকে ফ্লাইওভার হয়ে আসা গাড়িগুলো শুলকবহরের কাছে নামতে না পেরে আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ যানজট সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষার আগে তিন ঘণ্টায় মাত্র ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতে নগরজুড়ে সৃষ্টি হওয়া জলাবদ্ধতা দুর্ভোগে দিশেহারা নগরবাসী।
এখনো বর্ষা শুরু হয়নি। মৌসুমী বায়ু মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশ উপকূলে প্রবেশ করছে। বর্ষা শুরু হতে আরো সপ্তাহখানেক সময় লাগবে। কিন্তু মৌসুমী বায়ুর অগ্রভাগের কারণে শুরু হওয়া বৃষ্টিতে দুর্ভোগে নগরবাসী। গতকাল সকাল থেকে বৃষ্টি শুরু হলেও মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয় সকাল ৯টা থেকে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৪৪ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ডুবে যায় নগরীর প্রধান সিডিএ এভিনিউ সড়ক। ষোলশহর দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, শুলকবহর ও বহদ্দারহাট এলাকায় রাস্তার উপরে পানি জমে যায়। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে পানির উচ্চতা। এই এলাকায় পানি বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি কাপাসগোলা, বাদুরতলা, চকবাজার ফুলতলা, বাকলিয়া ডিসি রোড, বগারবিল, জিইসি মোড়, ঝাউতলা রেল গেইট, ওয়ার্লেস মোড়, পাহাড়তলী ঝর্না পাড়া, হালিশহর কে ব্লক, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, চৌমুহনী, সুপারিওয়ালা পাড়া, তিনপোলের মোড়সহ প্রভৃতি এলাকায় পানি জমে।
পানিতে মুরাদপুরে আটকে পড়া আব্দুল আওয়াল নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘সকাল ১০ টায় বায়েজিদ থেকে কালুরঘাট বিসিক শিল্প নগরীতে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছি। বায়েজিদ থেকে কোন রকমে মুরাদপুরে এসে এখন পানিতে আটকে আছি দুই ঘণ্টা ধরে। পানি দেখে মনে হচ্ছে আজ সারাদিনেও রাস্তা থেকে পানি নামবে না।’
অক্সিজেন মোড় থেকে বহদ্দারহাট বাঁদুরতলা এলাকায় দোকানে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয়েছিলেন ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইকবাল। শুলকবহরের রাস্তায় কোমর সমান পানি থাকায় কয়েক ঘণ্টা আটকে ছিলেন তিনি। এসময় বহদ্দারহাট স্বজন সুপার মার্কেটের সামনে বুক সমান পানি জমে যায়। একই চিত্র দেখা গেছে তিনপোলে মোড়ে এবং খাতুনগঞ্জেও।
কোন সময়ে কতো বৃষ্টি হলো?
দিনভর কিন্তু বৃষ্টি বেশি হয়নি। গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১২ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৮৬ মিলিমিটার। এরমধ্যে সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ মিলিমিটার, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৪ দশমিক ৩ মিলিমিটার, দুপুর ১২টা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত ২০ মিলিমিটার এবং বিকাল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই নগরী জলমগ্ন হয়েছে। এতো কম বৃষ্টিতে জলমগ্ন হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ পানি নামতে না পারা। জলাবদ্ধতা নিরসনে কাজ করা প্রকৌশলীরাও একই মত পোষন করেছেন রাস্তা থেকে পানি নামতে না পারার কারণেই জলাবদ্ধতা। এছাড়া অনেক সময় জোয়ারের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়া হয়, কিন্তু গতকাল এই সময়ে জোয়ারের প্রভাবও ছিল না। শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি নামতে না পারার কারণে বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতা হয়েছে।
বৃষ্টির পূর্বাভাস প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আবহাওয়া অধিদপ্তর পতেঙ্গা কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শহীদুল ইসলাম বলেন,‘ মৌসুমী বায়ুর অগ্রভাগের প্রভাবে এই বৃষ্টি। তবে কাল ( সোমবার) থেকে বৃষ্টির মাত্রা আরো কমে আসবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে মৌসুমী বায়ু পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং ধীরে ধীরে বৃষ্টির দিন সংখ্যাও বাড়তে থাকবে।’
বহদ্দারহাটে দীর্ঘ সময় পানি কেন ?
ষোলশহর দুই নম্বর গেট ও জিইসি মোড় এলাকাসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি দ্রুত নেমে গেলেও বহদ্দারহাটসহ আশপাশের এলাকায় পানি দীর্ঘসময় পর্যন্ত ছিল। এর কারণ জানতে চাইলে জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলী বলেন, চাক্তাই খালে মাটি ভরাট করে আমরা রিটেনিং দেয়াল নির্মাণ করছিলাম। এতে পানি দ্রুত নেমে যেতে পারছিল না। আর একারণেই এই এলাকায় পানি বেশি জমেছে এবং সহসা নামতে পারেনি।
এদিকে গত সপ্তাহে এই এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বহদ্দারহাট পুলিশ বক্সের কাছ থেকে ফুলতলা পর্যন্ত খালের উভয় পাশে রিটেনিং দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। এতে খালটি প্রায় ভরাট অবস্থায় রয়েছে। একপাশের সরু রাস্তা দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু বৃষ্টির সময় উজান থেকে আসা পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ হচ্ছে।
শুধু এই এলাকা নয়, সদরঘাট থেকে চাক্তাই পর্যন্ত আটটি খালের মুখ বন্ধ। এসব খালের কোনটিতে স্লুইস গেট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে, আবার কোনোটির মধ্যখানে মাটি ভরাট করে উভয় পাশে রিটেনিং দেয়াল নির্মাণের কাজ চলছে। বৃষ্টির সময় এসব খাল দিয়েও পানি নামতে না পেরে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ হচ্ছে।
কেটে দেয়া হবে খালের বাঁধ ও উত্তোলন করা হবে মাটি
খালে থাকা মাটি ও খালের মুখ বন্ধ করে কাজের কারণে নগরবাসী এবার গলা সমান পানিতে ভুগবে বলে কয়েকদিন আগে এক সভায় বলেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি অতি দ্রুত খাল থেকে মাটি উত্তোলন এবং খালের বাঁধগুলো কেটে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্ত তা যথাসময়ে বাস্তবায়ন হয়নি। গত সপ্তাহে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলীও বলেছিলেন, ‘চলতি মাসের চতুর্থ সপ্তাহে এসব বাঁধ কেটে দেয়া হবে। কিন্তু গতকালের বৃষ্টিতে নগরজুড়ে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ এবং আগাম বর্ষার কারণে বৃষ্টি বন্ধ হলেই খাল থেকে মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হবে এবং খালের বাঁধগুলো কেটে দেয়া হবে।’
তাহলে কি এই মৌসুমের কাজ শেষ? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ যেহেতু বর্ষা আগাম চলে এসেছে তাই আমরা এখনই কাজ শেষ করে দিচ্ছি। বৃষ্টি কমলে শুধুমাত্র খালের মাটি উত্তোলন এবং বাঁধগুলো কেটে দেয়া হবে। এখন আর কোনো কাজ করা যাবে না।’
রাস্তায় পানি জমছে কেন?
মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মো. শাহ আলী বলেন,‘ রাস্তা থেকে পানিগুলো খালে আসার জন্য আমরা ২১টি পয়েন্টে নতুন ড্রেন নির্মাণ করেছি। আরো যদি ৪০ শতাংশ ড্রেন নির্মাণ করা হয় তাহলে পানি কোথাও আটকাবে না।
তিনি আরো বলেন, রাস্তা থেকে ড্রেনে আনার জন্য ছোটো ড্রেনগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এখন সিটি কর্পোরেশন যদি নিয়মিতভাবে এসব কানেকটিং লাইনগুলো সংস্কার না করে তাহলে তো পানি জমবে। আমাদের বাড় নালা ও খালে পানিগুলো আসার সুযোগ করে দিলে পানি দ্রুত নেমে যাবে।
পানি জমেনি প্রবর্তক মোড়ে
তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানি জমে জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হলেও নগরীর প্রবর্তক মোড়ে তেমন দুর্ভোগ দেখা যায়নি। পানি জমলেও মূহূর্তের মধ্যে তা নেমে গেছে। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রবর্তক মোড় এলাকা সংস্কার করার কারণে এই এলাকায় পানি জমেনি। হিজরা খালের ব্রিজটি উঁচু করা হয়েছে এবং প্রবর্তকমোড়টি উঁচু করে আশপাশের এলাকা থেকে আশা পানিগুলো পৃথক ড্রেনের মাধ্যমে হিজরা খালের সাথে যুক্ত করা হয়েছে। আর এতে পানি দ্রুত নেমে গিয়েছে।
উল্লেখ্য, তিন বছর মেয়াদী মেগা প্রকল্পটি ২০১৭ সালে একনেকে অনুমোদন পেলেও বাস্তবে এর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের এপ্রিলে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (সিডিএ) প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হলেও সিডিএ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়। তিন বছরে এপ্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৫১ শতাংশ। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে চট্টগ্রামবাসী জলাবদ্ধতা দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পাবে।