`ভবন মালিকের গাফিলতিতে’ দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি

৬ দগ্ধদের মধ্যে মারা গেলেন ১ জন

১ বছর আগে একই ভবনে গ্যাস লিকেজের কারণে দগ্ধ হয়েছিলেন ৯ জন, প্রাণ হারায় দুজন

নিজস্ব প্রতিবেদক »
অবশেষে মারাই গেলেন সাজেদা বেগম (৪৫)। তার শরীরে প্রায় ৮০ ভাগ পুড়ে গিয়েছিল| পাশের শয্যায় বোধহীন শুয়ে আছে তার ৯ বছরের মেয়ে মাহি আক্তার। মা আর বোনের মাঝে দাঁড়িয়ে মেজো ছেলে লিমনের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল। পরিবারে ৫ ভাই-বোনের মধ্যে শুধু লিমনই রক্ষা পেয়েছে আগুন থেকে।
লিমনের বাবা অসহায় জামাল শেখ নির্বাক হয়ে হাসপাতালের এক রুম থেকে অন্য রুমে ছুটছে। এক রুমে তার স্ত্রী, মেয়ে ও বড় ছেলের স্ত্রী দিলরুবা (২৪)। অন্য রুমে দগ্ধ তার তিন ছেলে সানি শেখ (২৯), স্বাধীন শেখ (১৭), জীবন শেখ (১৫) মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক ইউনিটের এমন দৃশ্যে পুরো বার্ন ইউনিট ভারী হয়ে উঠে। গত সোমবার রাত ১১টায় এই দুর্ঘটনা ঘটে নগরীর উত্তর কাট্টলী কমিউনিটি সেন্টার রোডে মরিয়ম ভিলার ষষ্ঠ তলায় ভাড়াটিয়া জামাল শেখের বাসায়।
জানা গেছে, সোমবার রাতে ঘুমানোর আগে গল্প করছিলেন পরিবাবের সবাই। তখন মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে মশা মারার ব্যাট ব্যবহার করা হয়। ব্যাটের স্পার্ক থেকে মুহূর্তেই ঘরে জমে থাকা গ্যাসে আগুন ধরে বিস্ফোরণ ঘটে। ভেঙে যায় দরজা-জানালা। দগ্ধ হন ঘরে থাকা পরিবারের ৬ জন। মেজো ছেলে বাথরুমে থাকায় বেঁচে যায়। জামাল শেখ চাকরিতে থাকায় রক্ষা পায়।
আহত পরিবারের অভিযোগ, গ্যাসের লাইনে লিকেজের বিষয়টি একাধিকবার ভবনের কেয়ারটেকারকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। একটু সচেতন হলেই এড়ানো যেত এই দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমদ বলেন, সোমবার রাতে দগ্ধ হওয়া ছয় জনের মধ্যে পাঁচ জনেরই শ্বাসনালী পুড়ে গেছে, অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধদের শরীরের সাত শতাংশ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে।
দগ্ধদের মধ্যে সাজেদা বেগমের শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার ছেলে স্বাধীনের ৪২ শতাংশ ও জীবনের ৪০ শতাংশ এবং মেয়ে মাহিয়ার ৩৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। এছাড়া সানির ২০ শতাংশ ও তার স্ত্রী দিলরুবার শরীরের ৭ শতাংশ পুড়ে গেছে।
আগুনের সূত্রপাতের কারণ জানতে চাইলে সাজেদা বেগমের মেজো ছেলে লিমন বলেন, আমার ছোটবোন মশা মারার ব্যাট দিয়ে মশা মারছিল। সে সময় দরজা-জানালা সব বন্ধ ছিল। যে কারণে লিকেজের গ্যাস বাসা থেকে বের হতে পারেনি। মশা মারার সময় ব্যাট থেকে যে আগুনটা হয় তাতেই পুরো ঘর জ্বলে গেছে।
লিমন আরো বলেন, এক সপ্তাহ আগে বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেয়ে বাড়ির কেয়ারটেকারকে বিষয়টি জানিয়েছি। তাকে বাসায় এসে গ্যাসের লিকেজের বিষয়টি দেখার অনুরোধ করি। কেয়ারটেকার এসে দেখে বলেন, এটি কোনো সমস্যা নয়। দুর্ঘটনার দুই দিন আগে কেয়ারটেকারকে গ্যাস লিকেজ হওয়ার বিষয়টি আবারও জানিয়েছি। তাকে বলেছি, গ্যাসের গন্ধটা আরও বেশি হচ্ছে। কেয়ারটেকার আবারও আমাদের অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে ‘সমস্যা নেই’ বলে চলে যান। সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনার সময় সবাই গল্প করছিলেন। এই সময় বাথরুমে থাকায় বেঁচে যাই।
তিনি আরও বলেন, যাদের অবহেলার কারণে পরিবারের ছয় জন দগ্ধ হলেন তাদের বিচার চাই।
জানা গেছে, গত বছরও একই ভবনে গ্যাস লাইন লিকেজের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আগুনে দগ্ধ হয়েছিলেন দুই পরিবারের ৯ জন। এতে প্রাণ হারায় দুই জন। এ ঘটনায় তিন সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল স্টেশন। সে সময় তদন্ত প্রতিবেদনেও গ্যাস লাইন লিকেজের বিষয়টি খোঁজ পাওয়া গিয়েছেল বলে জানায় আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল স্টেশন এর সিনিয়র অফিসার মোহাম্মদ এনামুল হক।
চট্টগ্রামের আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহির হোসেন সুপ্রভাতকে বলেন, আজকের (গতকাল) বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ির মালিক ও ভবনের কেয়ারটেকারকে থানায় আনা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গত বছরও একই ভবনে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে। দুই জনের মৃত্যু হয়েছিল। সে সময় একটা অপমৃত্যু মামলা দায়ের করি। তবে কাউকে আসামি করা হয়নি।