বোনারপাড়ায় নেমে

জুয়েল আশরাফ »

একটু পরে ট্রেন বোনারপাড়া স্টেশনে পৌঁছাতেই শশব্যস্ত হয়ে উঠল অহাব। ট্রেন তখন পুরো থামেনি, ধীরে ধীরে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে, কিন্তু ততক্ষণে অহাব ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। হাত দিয়ে বারবার পকেট টিপে দেখে মানিব্যাগটা আছে কিনা। ব্যাগের চেইন ঠিক আছে কিনা দেখে নেয়। তারপর আবার দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকটাকে ধাক্কা দিয়ে বলে, ‘একটু সরে দাঁড়ান ভাই, আমি নামি।’
লোকটা কেবল হালকা হাসে, বলে, গন্তব্য মনে হয় আপনার ঠিকই ঠিক আছে।
অহাব উত্তর দেয় না। তার মন তখন ধড়ফড় করছে। দেড় বছর পর সে বোনারপাড়া নামছে। একসময়ের চেনা গন্ধ, ধুলা, কাঁচা মাটির হাওয়ায় মিশে থাকা নুন-ঝাঁঝালো স্মৃতি সব আবার হু-হু করে এসে ভিড় করছে। কিন্তু আজ সে সেন্টিমেন্ট নিয়ে আসেনি। আজ সে এসেছে নিশ্চিত হতে, একটা কথা জানতে।
স্টেশন থেকে বের হয়ে অহাব অটোয় ওঠে।
পাইকারপাড়া যাবেন?
ড্রাইভার তাকায়, নতুন না পুরান?
পুরান। বাবু মেম্বারের মোড়, জানেন?
জানি তো ভাই। কিন্তু ওদিকে রাস্তাঘাট খারাপ, চল্লিশ টাকা লাগবে।
অহাব কিছু বলে না। উঠে বসে। অটো চলতে শুরু করে। চারপাশে শুকনো ধুলাবালি। দোকানগুলোর সাইনবোর্ড আধা-মলিন। ছোট বাচ্চারা হাফপ্যান্ট পরে দৌড়াচ্ছে। কোথাও একটা পাঁঠা কাটার শব্দ। এমনকি সেই গন্ধটাও কাঁচা মাটিতে রক্ত, পরিচিত।
তবে আজ অহাবের ভিতরে আর শৈশব নেই। এই গ্রামের সাথে তার সম্পর্ক ছিন্ন হয়েছে দেড় বছর আগে, যেদিন মা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যান আর পরদিন ঠিক বিকেল বেলা মামাতো ভাই শামীমের ফোনে সে প্রথম শোনে, ভাই, কিছু কইব না, শুধু এইটা জানেন আপনার বউ আইজ সকাল থাইকাই হাসান ডাক্তাররে হোয়াটস্যাপে কিচ্ছা দিতেছিল। আমিও দেখি। চুপ কইরা থাকলাম।
তখনই অহাব ঢাকায় একা ফাঁকা হয়ে পড়ে। সন্দেহ আর অবিশ্বাসে সে স্তব্ধ হয়ে যায়।
মেহরীন কিছু বলেছিল, ওরা মিথ্যা বলছে, অহাব। তুমি তো জানো কেমন মানুষ তোমার মামাত ভাইয়েরা।
কিন্তু অহাব জানতো না। সে কোনো উত্তর দেয়নি, শুধু একদিন চলে যায় বাসা থেকে, চাকরি বদলায়, ফোন নম্বর পাল্টায়। মেহরীনের কোনো মেসেজেই সে রিপ্লাই দেয়নি।
কিন্তু গত সপ্তাহে সে একটা ছবি দেখে ফেলে ফেসবুকে। হাসান ডাক্তার, গ্রামের সেই বড়জোর উচ্চমাধ্যমিক পাস এক যুবক। এখন নিজের চেম্বার দিয়েছে বাজারের পাশে। তার ফেসবুকে আপলোড করা একটা ছবিতে ছিল শিশিরভেজা মাঠ, আর পাশে সাদা-কালো শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে এক নারী। মুখ ঝাপসা। কিন্তু ভঙ্গিমায়, শরীরের বাঁকে… অহাব নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল, ওটা মেহরীন। তাই সে এসেছে।
পাইকারপাড়ার মোড় থেকে নামতে না নামতেই তিনজন লোক তাকে দেখে ফেলে। একজন বলে, এইটা অহাব না? আহারে, কতদিন পর আইলারে ভাই!
আরেকজন, যিনি বাজারের চায়ের দোকানে কেতলি পাল্টান। জিজ্ঞেস করেন, ঢাই বছর তো হয়াই গেছে, এখন আইলেন?
অহাব ঠোঁটের কোণে হাসি আনে।
আসার দরকার হইছে।
সে মেহরীনের বাবার বাড়ির দিকে হেঁটে যায়। লালচে দেয়াল, পিছনের বাগানে একটা ছোট জামগাছ। ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল মেহরীন।
অহাব থেমে যায়। দুজনের চোখ মিলে যায়। একটুও চমকায় না মেহরীন, শুধু ধীরে হেঁটে আসে গেটের কাছে।
তুমি এসেছ?
শান্ত স্বরে বলে সে।
একটু কথা বলব তোমার সঙ্গে।
মেহরীন গেট খুলে দেয়।
ভেতরের উঠানে দুজন বসে। গাছের পাতা নাড়া দিচ্ছে বাতাসে। দূরে কোথাও রেডিও চলছে, ‘এই মন তোমাকে দিলাম…’
তুমি কি হাসান ডাক্তারর সাথে কিছু একটা…
অহাব বলে ফেলে, অস্বস্তি গিলে। মেহরীন তার দিকে একদৃষ্টে তাকায়।
তুমি কোনোদিন একটা প্রশ্ন করার আগেই বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছো।
কিন্তু আমি ছবিটা দেখেছি। তুমি দাঁড়িয়ে ছিলে ওর পাশে।
ছবি কখনও প্রমাণ না, অহাব। যে দিনটা তুমি ছবি দেখেছো, সেটা ছিল আমার খালার মৃত্যুবার্ষিকী। হাসান এসেছে চেম্বার থেকে ফ্রি হয়ে, বাজারের গেটে দেখা হইছে। দাঁড়ায়ে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে আম্মার বাজার করছি। তখন এক দোকানদার আমাদের ছবি তোলে।
তাহলে তুমি বলো না কেন এতদিন কিছু?
তুমি ফিরেছিলে কখন? আমি তো গেছিলাম তোমার ঢাকার ঠিকানায়। তিনবার। তুমি বদলে ফেলেছো সব। আমার মতো একটা মেয়ে… কে কীভাবে খোঁজ করবে?
অহাব থেমে যায়। হাত কাঁপে।
কিন্তু সবাই বলেছে, তুমি বদলে গেছো। হাসান ডাক্তার বলেছে, তোমার সাথে তার…
তুমি গ্রামবাসীদের মুখে কথা শোনো, অথচ যার হাত ধরে শহরে গেলে, তাকে বিশ্বাস করো না?
মেহরীনের চোখে তখন কোন অশ্রু নেই, কিন্তু একটা দুর্ভেদ্য শান্তি। সন্ধ্যার সময় অহাব বাসে চড়ে শহরের দিকে রওনা দেয়। চোখে ভাসে মেহরীনের মুখ। সে জানে, কিছু হারিয়ে গেছে। এটা ক্ষমা নয়। এটা ভুল বোঝাবুঝির শেষ নয়। এটা একটা বিশ্বাসচ্যুতি, যা আর মেরামত হয় না। পাশের সিটে এক বয়স্ক মানুষ জিজ্ঞেস করে, ভাই, বাড়ি যাচ্ছেন নাকি বাইরে যাচ্ছেন?
অহাব উত্তর দেয় না। বাইরে তাকায়। আলো-ছায়ার মধ্যে মিশে থাকে বোনারপাড়া।

ঢাকার আগারগাঁও বাসস্ট্যান্ডে যখন বাস থামে, তখন রাত প্রায় পৌনে এগারো। বাস থেকে নেমে অহাব অটোতে ওঠে, কিন্তু ঠিকানা বলার সময় জিভ জড়িয়ে আসে, রোড নম্বর তিন… না, পাঁচ… মানে নয়তলা বিল্ডিংটা…
অটোচালক তাকায় পেছন ফিরে, ভাই ঠিকানাটা কি আপনার মনে নাই নাকি?
অহাব শুধু বলে, চলেন। পথ দেখিয়ে দিলে চিনবেন।
আসলে ঠিকানা তার মনে নেই এমন নয়। আসল কথা হলো, এই শহর তার জন্য এখন আর পুরোপুরি নিজের না। একটা সময় সে চেনা মানুষদের নিয়ে, চেনা ভালোবাসার মধ্যে থাকত। এখন শহরটা শুধু গাছপালা, গলি আর লোকের ভিড়।
ফ্ল্যাটে ফিরে দরজা খুলেই সে দেখে জানালার পাশে ধুলো জমে আছে। রান্নাঘরের সিঙ্কে আগের দিনের বাসন। ফ্রিজে কিছু শুকিয়ে যাওয়া ব্রেড আর পনির। সে ফ্রিজ বন্ধ করে দেয়। সোফায় বসে পড়ে। মোবাইল হাতে নিয়ে বারবার খুলে আবার রেখে দেয়। মেহরীনের নাম কোথাও নেই। শুধু পুরনো হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট, সেখানে সর্বশেষ মেসেজ ছিল, তুমি অন্তত একবার শুনে নিতে পারতে। সত্যি জানার ইচ্ছাটাও ছিল না বুঝি? তারপর চারটে কল, কোনো জবাব দেয়নি অহাব। এখন সে হঠাৎ ভাবে, যদি একটাও কল ধরে শুনে নিত, যদি একবার তার চোখে চোখ রেখে শুধু জিজ্ঞেস করত, তুমি সত্যিই করেছো?’ তাহলে আজকের রাতটা এমন শূন্য লাগতো না।
পরদিন সকালে অফিসে বসে থেকেও মন বসে না। সামনে রাখা কম্পিউটারের স্ক্রিনে বিরক্তিকর এক্সেল শিট। পাশের ডেস্ক থেকে কলিগ শাওন জিজ্ঞেস করে, ভাই, সব ঠিক আছে? চোখ-মুখ দেখে তো কিছুই ভালো লাগতেছে না।
অহাব হালকা হেসে বলে, ভালো না থাকলেও, ঠিক আছি বলতেই হয়, না?
শাওন মাথা নাড়ায়।
মন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে মুছে ফেলার চেয়ে বরং স্বীকার করলেই একটু হালকা লাগে।
অহাব এবার চুপ করে থাকে। শাওনের কথাটা কেমন যেন গায়ে বিঁধে যায়। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকে সে হঠাৎ ফেসবুকে ঢোকে। হাসান ডাক্তার আবার নতুন ছবি দিয়েছে। এইবারেও পাশে কেউ নেই, শুধু একা বসে স্টেথো গলায় ঝুলিয়ে রেখেছে। অহাব হঠাৎ এক ঝলকে কমেন্টগুলো পড়ে। নিচে মেহরীনের একটা কমেন্ট চোখে পড়ে, এই ছেলেটা একদিনের জন্যও আমাকে অপমান করেনি। সমাজের চেয়ে অনেক বড় সে।
অহাব এবার নিজের ভেতরেই কাঁপে। সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। শুধু বোঝে, সে আসলে একদিনও মেহরীনের পাশে দাঁড়ায়নি। একটিবারও ‘বিশ্বাস’ শব্দটাকে ধৈর্যের সঙ্গে ব্যবহার করতে শেখেনি। তার অল্প শিক্ষা, অল্প সফলতা, অল্প ভালোবাসা সবকিছুই ঢেকে গিয়েছিল বড় এক অহংকারে।
এক সপ্তাহ পর অহাব আবার বোনারপাড়ায় ফেরে। কোনো ফোন না করে, হুট করে। মেহরীনের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সে এবার নিজের হৃদয়কে প্রস্তুত রেখেছে। না, সে মেহরীনের কাছে কোনো হিসেব চাইবে না, কোনো প্রশ্নও করবে না। সে শুধু একবার চোখে চোখ রাখবে। শুধু বলবে, ভুল করেছি, আর এই ভুলটা আমি আজীবন বইব।
গেট খুলে যায়। মেহরীন এবার আর অবাক হয় না। সোজা বলে, এইবার তাহলে কী শুনবে?
অহাব চুপচাপ বলে, শুধু এটুকু বলতে এসেছি, তোমার কাছে ফিরে আসার অধিকার আমার নেই। তবু যদি কোনোদিন শুধু… বন্ধু হতে পারি, সেটা হলেও বাঁচি।
মেহরীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, বাঁচা শুরু হোক, অহাব। আবার নতুন করে।

বোনারপাড়ার বিকেলটা চুপচাপ হয়ে আসে দ্রুত। চারদিকে হাঁসফাঁস করা আলো, মাটির গন্ধ আর নিঃশব্দে থেমে থাকা সময়। মেহরীনের উঠানে আজ আর কেউ নেই। শুধু এক কাপ চা রাখা অহাবের সামনে। মেহরীন উঠে ভেতরে যায়, মিনিট পাঁচেক বাদে হাতে নিয়ে আসে একটা পুরনো লাল কম্বল। সেটা অহাবের দিকে বাড়িয়ে দেয়, তুমি থেকে যাও আজ। ঢাকায় আর ফিরতে হবে না এখনই। এক রাত থাকো।
অহাব চমকে তাকায়।
তুমি নিশ্চিত?
আমি তো অনেক আগেই নিশ্চিত ছিলাম, মেহরীন ধীরে বলে। তুমি বরং দেরি করে এসেছো।
একটা হালকা হাসি মেহরীনের ঠোঁটে খেলে যায়। অহাব তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। যেন দেখছে নতুন করে।
তুমি বদলাওনি একটুও, অহাব বলে।
তুমি কেবল আমার অপেক্ষা বন্ধ করেছিলে।
মেহরীন এবার সত্যিকারের হাসে।
আমি শুধু তোমার মতো করে বোঝা ছেড়ে দিয়েছিলাম। নিজেকে বোঝা শুরু করেছিলাম।
সেই রাতে দুজন বসে থাকে উঠানের কুয়াশার ভেতর। অনেক কথা হয় না। তবে একসময় অহাব বলে, তোমার যদি ইচ্ছে হয়… আমি আবার শুরু করতে চাই। খুব আস্তে, খুব ধীরে। কোনো দাবি ছাড়া। কেবল পাশে থাকতে চাই।
মেহরীন কাঁধ নামিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ। তারপর চোখ মেলে বলে, আমি তো অনেকদিন ধরেই সেই অপেক্ষায় ছিলাম। তবে এবার একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত? অহাব জিজ্ঞেস করে।
তুমি আমার কাছে ‘ক্ষমা’ চাইবে না। কারণ ভালোবাসায় ক্ষমা হয় না, শুধু বোঝা হয়। আর বোঝা হলে মানুষ একসাথে হাঁটতে শেখে।
অহাব মাথা ঝোঁকায়, শান্তভাবে।
দুই বছর পর।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে এক ছোট্ট বাসা। বারান্দায় গাছের টব, বেলিফুলের ঘ্রাণ। মেহরীন দুপুরে অফিস থেকে ফিরে কিচেনের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে, অহাব মাছ কাটছে। পাশেই মোবাইলে পুরানো রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজছে, এই পথ যদি না শেষ হয়…
মেহরীন বলে, তোমার অফিস নেই আজ?
আছে। কিন্তু আজ তোমার মাথাব্যথা ছিল তাই ভাবলাম দুপুরে একটু রান্না করি, পরে যাব।
মেহরীন হেসে ওঠে।
তুমি তো বদলে গেছো।
অহাব মুখে কিছু বলে না। শুধু একটু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে বলে, বদলাইনি। বুঝতে শিখেছি।