নিজস্ব প্রতিবেদক »
সাহিত্যিক,শহীদ জায়া, নারীনেত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বেগম মুশতারী শফী আর নেই। আজ ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে আজ বিকেল ৫টায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহি….রাজেউন।
৮৪ বছর বয়সী মুশতারী শফী কিডনি, রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর থেকে তিনি সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
মুশতারী শফী ১৯৩৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ফরিদপুর জেলায়। তার পিতার কর্মস্থল ছিল কলকাতায়।
১৯৬০-এর দশকে তিনি চট্টগ্রামে ‘বান্ধবী সংঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠন থেকে তিনি ‘বান্ধবী’ নামে একটি নিয়মিত পত্রিকা প্রকাশ করেন ও ‘মেয়েদের প্রেস’ নামে একটি ছাপাখানা চালু করেন।
মুশতারী শফী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী’, ‘চিঠি, জাহানারা ইমামকে’ এবং ‘স্বাধীনতা আমার রক্তঝরা দিন’। এছাড়াও তিনি প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, কিশোর গল্পগ্রন্থ, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ প্রভৃতি শাখায়ও অবদান রেখেছেন। অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ভ্রমণ কাহিনী নিয়ে লেখা ‘আমি সুদূরের পিয়াসী’, স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ, ‘স্মৃতিতে অমলিন যারা’, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ছোটগল্পের সংকলন ‘দুটি নারী ও একটি মুক্তিযুদ্ধ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’ ও ‘একুশের গল্প’সহ প্রভৃতি।
ব্যক্তিগত জীবনে মুশতারী চট্টগ্রামের দন্ত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ শফীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৭১ সালেরে এপ্রিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মোহাম্মদ শফি ও তার ছোট ভাই এহসান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় শফী পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুশতারীর দাদা কাজী আজিজুল হক ছিলেন একজন বাঙালি উদ্ভাবক ও ব্রিটিশ ভারতীয় পুলিশে কর্মরত একজন কর্মকর্তা। তিনি হস্তছাপ (ফিঙ্গার প্রিন্ট) রক্ষনের মাধ্যমে অপরাধী সনাক্তকরনের উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালনের জন্য বাংলা একাডেমি ২০১৬ সালে তাঁকে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করে। তিনি গত বছর ২০২০ সালে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’।
শহীদ জায়া মুশতারী শফীর মৃত্যুতে দেশ একজন ত্যাগী ও সংগ্রামী ব্যক্তিকে হারালো বলে জানালেন একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবুল মোমেন। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবসময় অগ্রনী ছিলেন মুশতারী শফী। তাঁর বাড়িতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার বৈঠক হয়েছিল। আর এতেই তিনি পাকিস্তানীদের টার্গেটে পরিণত হন। একপর্যায়ে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে গিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেন।’
কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে এসে তিনি বেতারে চাকুরি করে সন্তানদের গড়ে তোলেন। একইসাথে রাজপথে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবসময় তাঁর সরব উপস্থিতি ছিলো।’
বিশিষ্ট লেখক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মুশতারী শফীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শিক্ষাবিদ, নারীনেত্রী ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর হান্নানা বেগম বলেন, বেগম মুশতারী শফী নারী আন্দোলন ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানাবিধ সাংগঠনিক তৎপরতার মাধ্যমে অসামান্য অবদান রাখেন। মহিলা পরিষদ চট্টগ্রাম শাখা গঠনে তিনি আমাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর লেখা গ্রন্থসমূহ মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল হিসেবে সমাদৃত হবে।
মঙ্গলবার সকাল ১১টায় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রাখা হবে শহীদ জায়া মুশতারী শফির মরদেহ। এরপর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হবে মরদেহ। চট্টগ্রামের মানুষ যাতে শ্রদ্ধা জানাতে পারে সেজন্য বুধবার চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে তাঁর মরদেহ রাখা হতে পারে।