চিরন্তন চট্টগ্রামকে তুলে ধরা হবে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ‘ঐতিহ্য কর্নারে।’ চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের ১৮তলা বিশিষ্ট নতুন ভবনের ৮ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরে এই ঐতিহ্য কর্নার স্থাপন করা হবে। যাতে চট্টগ্রামের বীরত্ব, ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি স ংরক্ষণ করা হবে। গতকাল বিকালে চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের অস্থায়ী কার্যালয়ে চট্টগ্রাম ঐতিহ্য কর্নার স্থাপনে গঠিত কমিটির প্রথম সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনের সভাপতিত্বে এবং চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও কমিটির সদস্যসচিব এ টি এম পেয়ারুল ইসলামের সঞ্চালনায় এতে বক্তব্য রাখেন সাবেক মুখ্যসচিব আবদুল করিম, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আকতার, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পরিচালক মিনার মনসুর, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আকতার, টিআইসি চট্টগ্রামের পরিচালক আহমেদ ইকবাল হায়দার, ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ, দৈনিক পূর্বকোণের সিটি এডিটর নওশের আলী খান, ড. জ্ঞানরতœ মহাথের, ড. আনোয়ারা আলম, স্থপতি আশিক ইমরান, সাংবাদিক মুহাম্মদ শামসুল হক, লোকসঙ্গীত গবেষক নাসির উদ্দিন হায়দার, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল, সাংবাদিক ডেইজি মউদুদ, শিল্পী দীপক দত্ত। উপস্থিত ছিলেন এডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, নির্বাহী কর্মকর্তা দিদারুল আলম।
সভাপতির বক্তব্যে ড. অনুপম সেন বলেন, বিশ^সভ্যতার সাথে চট্টগ্রামকে মিলিয়ে উপস্থাপন করার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, বাইরে থেকে যারা চট্টগ্রাম আসবে তারা এই জনপদের ইতিহাস এখানে এসে দেখবে। চট্টগ্রামেরও যে হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে তা জানতে পারবে তারা। এটি একটি অসাধারণ উদ্যোগ। সাবেক মুখ্যসচিব আবদুল করিম বলেন, বাঙালি এবং কুকুর প্রবেশ নিষেধের কথা চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাবের মতো ঢাকায়ও লেখা ছিল। কিন্তু বিদ্রোহটা চট্টগ্রাম থেকেই হয়েছে। তাই চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য, কবিতা, গান ইত্যাদি সংরক্ষণে সমান গুরুত্ব দিতে হবে। চট্টগ্রাম ঐতিহ্য কর্নারে চট্টগ্রামের আমলা এবং সামরিক কর্মকর্তাদের নামের তালিকাও অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি। এখানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার পাশাপাশি সোস্যাল মিডিয়াকে কাজে লাগাতে হবে।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা ঐতিহ্য কর্নারের নাম ‘চিরন্তন চট্টগ্রাম’ রাখার প্রস্তাব করে বলেন, শুধু চট্টগ্রাম জেলা নয়, বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে কাজ করতে হবে। এখানে তিন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজারকেও অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি।
সুফি মিজানুর রহমান ৫৮ বছর ধরে তাঁর চট্টগ্রামে বসবাস করার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ ধরনের উদ্যোগ তিনি আগে আর কাউকে নিতে দেখেননি। এজন্য তিনি চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ধন্যবাদ জানান।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আকতার বলেন, আমরা ইতোমধ্যে অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি। চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে একটি সমৃদ্ধ জাদুঘর রয়েছে। আজ চট্টগ্রাম জেলা একটি বড় পরিসরে চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যরক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে, যা সত্যিই আনন্দের বিষয়।
চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে চট্টগ্রামে অভুতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু আমরা যেন এক অন্য উন্মাদনার মধ্যে আছি। মোবাইল আসক্তিসহ নানা কারণে নতুন প্রজন্ম চট্টগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা ভুলে যাচ্ছে। মূলত তাদের লক্ষ করেই এই বিষয়টি নিয়ে তিনি সমাজবিজ্ঞানী ড. অনুপম সেনের সাথে আলোচনা করে এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানান। এই উদ্যোগকে সফল করতে তিনি সবার সহযোগিতায় কামনা করেন।
টিআইসি চট্টগ্রামের পরিচালক আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, অবস্থাটা এখন এমন যে চট্টগ্রামের কথা যেভাবে বলি, সেভাবে অনুভব করি না। এটিকে মনেপ্রাণে উপলব্ধি করাতে পারলেই আজকের আয়োজন সার্থক হবে। আমরা জেলা পরিষদ ভবনের ৮ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্লোরের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে সিআরবি, জালালাবাদ পাহাড়সহ যেসব ঐতিহ্য আছে সেসব সংরক্ষণ এবং প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে পারি।
ডা. মঈনুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, চট্টগ্রামে অনেক বাড়িতে অনেক ঐতিহাসিক চিহ্ন রয়েছে। এই চিহ্নগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। প্রয়োজনে এসব কিনে নিতে হবে। ঐতিহ্য কর্নার এমনভাবে করতে হবে যাতে কেউ চট্টগ্রামে এসে এসব না দেখে ফিরে গেলে তার মনে হবে কিছুই তো আসলে দেখা হল না। সাংবাদিক নওশের আলী খান কর্ণফুলী নদীর ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তথ্য দিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র পরিচালক মিনার মনসুর বলেন, এই উদ্যোগ সফল করতে হলে বিভিন্ন উপকমিটি গঠন করতে হবে। একটি সভা দিয়ে কাজটি শেষ হবে না। তাকে যতবার ডাকা হবে তিনি ততবার আসবেন বলে জানান। জেলা পরিষদের একটি ছোট দলকে কলকাতা ভিকটোরিয়া মেমোরিয়াল পরিদর্শন করে ধারণা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আকতার বলেন, ১৮ তলা ভবনের গেট, বারান্দাসহ সর্বত্র এই এতিহ্যের ছোঁয়া থাকা চাই।
ড. জ্ঞানরত্ন মহাথের বলেন, চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল ধর্মাবলম্বী ও তাদের সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। সাংবাদিক নাসির হায়দার চট্টগ্রামের গান সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করে বক্তব্য রাখেন। ড. আনোয়ারা আলম বলেন, নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে সরে যাচ্ছে। লাইব্রেরিমুখী হচ্ছে না। এটি একটি অশনি সংকেত। আমরা যদি আমাদের সন্তানদের লাইব্রেরিমুখী করতে না পারি, ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা দিতে না পারি, সেটা হবে আমাদেরই ব্যর্থতা। জেলা পরিষদের এই উদ্যোগ সেই সংকট কাটাতে পথ দেখাবে, আশা করি। স্থপতি আশিক ইমরান ঐতিহ্য কর্নার নির্মাণের ক্ষেত্রে আর্কিটেকচারাল ডিজাইন প্রণয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ^াস দেন। এক্ষেত্রে তিনি চুয়েট এবং প্রিমিয়ার বিশ^বিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারাল বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর পরামর্শ দেন।
সাংবাদিক মুহাম্মদ শামসুল হক বলেন, ইতিহাস না জানার কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান দেশবিরোধীদের সাথে বিপথে চলে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরে তা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেয়ার আহবান জানান তিনি ।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাব্বির ইকবাল বলেন, চট্টগ্রাম দেশের অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে স্বতন্ত্র। চট্টগ্রাম হল বাংলাদেশের কেন্দ্র। আবহমানকাল ধরে এই জেলা সমৃদ্ধশালী জনপদ। ঐতিহ্য কর্নারের মাধ্যমে সেটা তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।
সাংবাদিক ডেইজি মউদুদ বলেন, চট্টগ্রামের অনেক ঐতিহ্য ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমরা নিজেদের তুলে ধরতে পারছি না। এই উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রামকে তুলে ধরতে পারবো বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সভায় শিল্পী দীপক দত্ত কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ন্যায় লাইট এন্ড সাউন্ড সিস্টেমের মাধ্যমে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য তুলে ধরার পরামর্শ দেন। বিজ্ঞপ্তি