নিজস্ব প্রতিনিধি, সীতাকুণ্ড »
সীতাকুণ্ডের অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে ৬ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৩০ জন। শনিবার বিকাল সাড়ে চারটায় উপজেলার কদমরসুল এলাকায় সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রকট বিস্ফোরণে আশেপাশের দুকিলোমিটার এলাকা প্রকম্পিত হয়। এতে বিভিন্ন অফিস ও ঘর বাড়ির কাঁচের দরজা জানালা ভেঙে যায়। আহতদের উদ্ধার করে চমেকে অন্যান্যদের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে।
বিস্ফোরণ এতোটাই প্রকট ছিল যে, পুরো কারখানার স্টিলের ছাউনি উড়ে গিয়ে এর বিচ্ছিন্ন অংশগুলো প্রায় দু’শ মিটার পর্যন্ত দূরে গিয়ে পড়ে। একটি স্টিলের অংশ ঘটনাস্থল কারখানা থেকে দু’শ মিটার পশ্চিমে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছে শামসুল নামে একজনের গায়ে পড়লে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। শামসুল কদমরসুল এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতো।
নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- সীতাকু-ের ফৌজদারহাট বাংলাবাজার এলাকার বাসিন্দা ফরিদ (৩৪), সীতাকু-ের কদমরসুল এলাকার শামসুল আলম (৬৫), নেত্রকোণার কলমাকান্দা উপজেলার ছোট মনগড়া গ্রামের মিকি রেঙি লখরেটের ছেলে রতন লখরেট (৪৫), নোয়াখালীর সুধারাম থানার অলিপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে আবদুল কাদের (৫০) এবং লক্ষ্মীপুরের মো. সালাউদ্দিন।
আহতরা হলেন মো. ফোরকান (৩৩), মো. নুর হোসেন (৩০), মোতালেব (৫২), মো. আরাফাত (২২), মাকসুদুল আলম (৬০), মো. ওসমান (৪৫), মো. সোলায়মান (৪০), মো. রিপন (৪০), মো. আজাদ (২২), রিপন (৬০), নারায়ন ধর (৬৪), মো. জসিম (৫০), ফেন্সী (২৬), মো. জাহেদ (৩০), মুবিবুল হক (৪৫), রোজি বেগম (২০) ও মাহিন শাহরিয়ার (২৬)। একজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কারখানার স্টিলের ছাদ উড়ে গিয়ে ধ্বংসস্তুূপ হয়ে আছে। তিনতলা বিশিষ্ট অফিস ঘরটির কোনো দরজা-জানালা নেই, সব উড়ে গেছে। পাশের সীমানা প্রাচীর দেয়ালটি ফাটল দিয়ে পশ্চিমে হেলে পড়েছে। ধসে পড়া দেয়াল ও লোহার বিশাল আকৃতির অ্যাঙ্গেলের ধ্বংসস্তুূপের নিচ থেকে লাশ উদ্ধার করছে দমকল বাহিনী, গাউছিয়া কমিটির লোকজন ও স্থানীয়রা।
৫টি ট্রাক আগুনে সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। অক্সিজেনের সিলিন্ডার ভর্তি একটি ট্রাকে দমকল বাহিনী পানি ছিটাচ্ছে। দুঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিটের সদস্যরা। বিকাল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কারখানার ভেতর থেকে ৫ জনের ও বাইরে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশ থেকে ১ জনসহ মোট ৬ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। ধ্বংসস্তূপের নিচে আরও লাশ থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেন স্থানীয় উদ্ধার কর্মীরা।
আগ্রাবাদ ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক জানান, ‘আমরা দুর্ঘটনাস্থলে অনেক সিলিন্ডার দেখেছি। অনেক সময় সিলিন্ডারগুলো পরীক্ষা করা হয় না। বিস্ফোরণের অনেক কারণ থাকতে পারে। তদন্তে তা বোঝা যাবে। তবে সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে আমরা মনে করছি।’
রাইসুল ও টিটু নামক দুই উদ্ধার কর্মী জানান, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর আমরা কারখানায় ঢুকে দেখি এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য, একজনের হাত ও একজনের পা নেই।
ব্রাদার স্টিলের স্বত্বাধিকারী ফরিদুল আলম জানান, ঘটনাস্থল থেকে ২শ মিটার তিনটি কারখানা দূরে আমার কারখানা, এখানে আমার অফিসের কাঁচের দরজা জানালা সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানান, আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া হবে।
সীতাকু- ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার নুরুল আলম দুলাল জানান, দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সীতাকু- থেকে ৪টি ও আগ্রাবাদ থেকে ৩টি মোট ৭ ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ করে। আমরা ২ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি।
এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় হতাহতদের স্বজনদের আহাজারি করতে দেখা যায় চট্টগ্রাম মেডিক্যালে। হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ভেতরে এবং বাইরে উপচে পড়া ভিড়। রোগীদের দ্রুত ট্রলিযোগে ক্যাজুয়ালিটি ওর্য়াডে ভর্তি করানো হচ্ছে। আহতদের বেশির ভাগ শরীরের বিভিন্ন অংশ উড়ে গেছে।
নিহত শামসুলের বড় ভাই ওবায়দুর মোস্তফা জানান, ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ গজ দূরে একটা লাকড়ির দোকানে শামসুল বসেছিলেন। ‘২৫০ থেকে ৩০০ কেজি ওজনের একটা টুকরা দোকানের উপর এসে পড়ে। তার চাপায় ওনার প্রচুর পরিমাণে রক্তক্ষরণ হয়।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান সাংবাদিকদের বলেন, চট্টগ্রাম মেডিক্যালে মোট ২১ জনকে আনা হয়েছে, তাদের মধ্যে ৩ জন মৃত।
তিনি বলেন, ‘আহতদের বেশিরভাগেরই আঘাতজনিত সমস্যা। দুজন মস্তিষ্কে আঘাত পেয়েছেন। আমাদের সকল চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারী প্রস্তুত আছেন। চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রক্ত, স্যালাইন ও ওষুধপত্র ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি
সীতাকু- উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘দুর্ঘটনার কারণ তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসক। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে এ কমিটি করা হয়। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’
কন্ট্রোল রুম চালু ও আর্থিক সহায়তা
এদিকে, হতাহতদের তথ্য আদান-প্রদান ও সহযোগিতায় চমেক হাসপাতালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করা হয়েছে।
এনডিসি তৌহিদুল ইসলাম জানান, নিহতদের দাফনের জন্য দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার টাকা, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে দুই লাখ টাকা করে সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়।
এছাড়া, আহতদের চিকিৎসার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সাড়ে সাত হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন থেকে তাদের ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা ও ওষুধপত্র এবং হাসপাতালে তাদের স্বজনদের খাবারের ব্যবস্থা করছে জেলা প্রশাসন।
সীমা অক্সিজেন লিমিটেড সীমা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি চট্টগ্রামের মাঝারি আকারের ব্যবসা পরিসরের একটি শিল্পগোষ্ঠী, যাদের ইস্পাত কারখানা, জাহাজভাঙা কারখানা ও অক্সিজেন কারখানা রয়েছে। প্রয়াত ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। এখন তার সন্তানেরা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন।