সুপ্রভাত ডেস্ক :
বিভিন্ন মন্দিরে আপনারা ঘন্টা বাজাতে দেখেছেন নিশ্চয়! যে ঘণ্টা বাজিয়ে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মন্দিরে গিয়ে পূজা অর্চনা করে থাকেন। এছাড়াও বিভিন্ন উৎসবে ঘণ্টা বাজানো হয়ে থাকে। তবে সেসব ঘণ্টা তো আকারে ছোট হয়ে থাকে। বড়ও আছে হয়ত তবে আজ যে ঘণ্টার বিষয়ে জানাব সেটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঘণ্টা।
বিশ্বের বৃহত্তম এই ঘণ্টার নাম ‘জার বেল’। রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ক্রেমলিন ভবনের পাশেই এর অবস্থান। এই ঘণ্টাটি রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেট এর ভ্রাতুষ্পুত্রী আন্না ইভানোভা এর নির্দেশে নির্মিত হয়। অবাক করা বিষয় হলো, এই বিশালাকার ঘণ্টাটি কখনো বাজানো হয়নি।
জার ঘণ্টাটি ইভান গ্রেট বেল টাওয়ার এবং ক্রেমলিন প্রাচীরের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ব্রোঞ্জের তৈরি ঘণ্টাটির নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এতে ফাটল ধরে। বিশ্বের বৃহত্তম এই ঘণ্টার ওজন দুই লাখ ১৯২৪ কিলোগ্রাম। ঘণ্টাটির উচ্চতা ৬ দশমিক ১৪ মিটার এবং ব্যাস ছয় দশমিক ছয় মিটার। এই ঘণ্টার পুরুত্ব ৬১ সেন্টিমিটার। এক আগ্নিকাণ্ডের সময় এর ভেঙে যাওয়া অংশটির ওজনই ছিল সাড়ে ১১ হাজার কিলোগ্রাম।
রাশিয়ায় খ্রিষ্টীয় ১০তম শতাব্দীতে বৃহৎ ঘণ্টা নির্মাণের প্রচলন ঘটে। সেসময় বড় ঘণ্টা নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর আক্রমণের কিংবা অগ্নিকাণ্ডের সতর্কতা প্রদান করা। তবে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানের ঘোষণার জন্যও ঘণ্টা ধ্বনি বাজান হতো। ১৬০০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম একটি বিশাল জার ঘণ্টা নির্মাণ কাজ শেষ হয়। এটি ইভান দ্য গ্রেট বেল টাওয়ারে স্থাপন করা হয়েছিল।
এই ঘণ্টাটির ওজন ছিল ১৮ হাজার কিলোগ্রাম। ঘণ্টাটি বাজানোর জন্য ২৪ জন মানুষের প্রয়োজন হতো। ১৬৫০ খ্রিষ্টাব্দের কাছাকাছি সময়ের একটি অগ্নিকাণ্ডে মস্কোর ক্রেমলিনের ঘণ্টাটি নষ্ট হয়ে যায়। একই স্থানে দ্বিতীয় জার ঘণ্টা তৈরি করা হয় ১৬৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। তবে এটি প্রথমটির চেয়ে বেশ বড় ছিল। নতুন এই ঘণ্টাটির ওজন হয় এক লাখ কিলোগ্রাম।
১৭০১ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে দ্বিতীয় জার ঘণ্টাটিও ধ্বংস হয়ে যায়। রাশিয়ার জার পিটার দ্য গ্রেটের ভ্রাতুষ্পুত্রী আন্না ইভানোভা সম্রাজ্ঞী হওয়ার আগের চেয়েও বড় জার ঘণ্টা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। সম্রাজ্ঞী নতুন ঘণ্টা তৈরির দায়িত্ব দেন প্যারিসের এক কারিগরকে। তবে প্যারিসের কারিগর এই বিশালাকার ঘণ্টা তৈরি অসম্ভব বিবেচনা করে নির্মাণ করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরবর্তীতে সম্রাজ্ঞী আন্না ১৭৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বিখ্যাত একজন রুশ কারিগরকে ঘণ্টা নির্মাণের দায়িত্ব প্রদান করেন। এই রুশ কারিগর পূর্বে একটি ব্রোঞ্চের কামান তৈরি করে খ্যাতি লাভ করেন। প্রায় দুই বছর ধরে এই ঘণ্টা তৈরির কাজ অব্যাহত গতিতে চলে। তবে এই প্রকল্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ কারিগরের মৃত্যুতে ঘণ্টা তৈরিতে বিঘ্ন ঘটে। মৃত ওই ব্যক্তিকে ছাড়া বেশ কিছু অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
এরপর মূল কারিগর মিখাইল মতরিন প্রায় ২০০ জন কারিগরের সাহায্য নিয়ে বাকি কাজ সমাপ্তের উদ্যোগ নেন এবং ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের এর নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ঘণ্টাটি তৈরির শেষ দিকে আরেকটি আগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল ক্রেমলিনে। সে সময় ব্রোঞ্চের এই ঘণ্টাটি একটি গর্তে অস্থায়ী কাঠের তৈরি কাঠামোর মধ্যে রেখে স্বাভাবিকভাবে শীতল করা হচ্ছিল।
দ্রুত আগুন নেভাতে প্রচুর শীতল পানি ব্যবহার করে হয়েছিল। শীতল পানি ঢালায় ঘণ্টায় ১১টি ফাটল সৃষ্টি হয় এবং একটি অংশ ভেঙে যায়। ভেঙে যাওয়া এই অংশের ওজন প্রায় ১১ হাজার কিলোগ্রাম। গর্তে যে কাঠামোর উপর ঘণ্টাটি নির্মাণ করা হয়েছিল সেটি অগ্নিকাণ্ডের সময় নষ্ট হয়ে যায় ফলে সেখান থেকে সেসময় এতো ওজনের ঘণ্টা ওঠানো সম্ভব হয়নি।
প্রায় ১০০ বছর ঘণ্টাটি এই গর্তেই ছিল। ১৭৯২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮১৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বেশ কয়েকবার গর্ত থেকে উঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়। নেপলিয়ান বোনাপার্ট ১৮১২ খ্রিষ্টাব্দে মস্কো দখল করেছিলেন। সে সময় তিনি এটি বিজয় স্মারক হিসেবে ফ্রান্সে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে ওজন এবং আকারের জন্য নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।
১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ফরাসি স্থপতি অগুস্তে দে মন্তফ্রেন্দ ঘণ্টাটি গর্ত থেকে উত্তলোন করতে সক্ষম হন। তিনি ক্রেমলিনের পাশে একটি পাথরে ভিত্তস্তম্ভের উপর স্থাপন করেন। আর এর ভাঙা অংশটি মূল ঘণ্টার পাশেই রাখা হয়। তবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই ঘণ্টাটি কখনো বাজানো হয়নি।
খবর : ডেইলিবাংলাদেশ’র।