ড. আনোয়ারা আলম»
একটা মহামারি অতিক্রম করে নতুন এক জীবনে যখন প্রবেশ করছি, মনে হয়েছিল এটি এক শিক্ষা হবে। আমরা অনেকে শতশত প্রিয়জন হারিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় তখনই হয়তো ভেবেছিলাম এ পৃথিবীর সব অনাচার, অবিচার, নির্যাতন আর লোভ মোহ সব পেরিয়ে গড়ে উঠবে এক নতুন পৃথিবী।
কিন্তু সব আশাই বিফলে। উন্নত দেশগুলোর আগ্রাসী আচরণ বা নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের লোভ শেষ হয়নি। বরং বেড়েছে। যে করোনায় বিশ্বের প্রায় সব দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের দাম এভাবে বৃদ্ধি পায়নি; কিন্তু করোনার পরশ না যেতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সব দেশের লোকজনের পেটে এসেছে চরম আঘাত। আমরা এক কঠিন সময় পার করছি।
আত্মীয় স্বজনের অনেকে দেশের বাইরে। শুনেছি অনেক দেশে খাদ্যদ্রব্যে রেশনিং পদ্ধতিতে বণ্টন চলছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যে।
আমরাও চরম সংকটে দিশেহারা অনেকটা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধীরে ধীরে বিলুপ্তি ঘটছে। আর এটির অপর নাম বিশ্বায়নের দাপট।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকে এর ধারণা অর্থনীতি থেকে সংস্কৃতি, পণ্যবিপণন থেকে রাজনীতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়। রাজনীতি, সমাজজীবন ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিশ্বায়নের টানাপোড়েন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে বিশ্বায়ন শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, বিশ্বায়নের কারিগরি, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মাত্রাও রয়েছে। বিশ্বায়নের সাথে স্থানিকায়নের একটা দ্বন্দ্বও দেখা দিয়েছে। আমাদের আত্মপরিচয়ও হুমকির মুখোমুখি। বিশ্বায়ন নানাভাবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা রাষ্ট্রের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে সাধারণ মানুষের কোন অধিকার নেই। খেয়াল করে দেখুন বিশ্বায়নের ফলে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখোমুখি। মহামারির মতো ভাষার রূপ বদলে যাচ্ছে। খাদ্যাভ্যাস, আচার-আচরণ এমনকি পোশাকেও কেমন পরিবর্তন! পুরো পৃথিবীর মানুষ দুই নৌকায় পা দিয়ে আছে একটি বিশ্বায়নের স্রোতধারায় অন্যটি স্থানিকায়নের দিকে। কোথাও কোথাও সমন্বয়।
বিশ্বায়নের বড়ো সমস্যা হলো অ- শিল্পায়ন মানে শিল্প উৎপাদনে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব। ফলে কোন কোন দেশ তাদের রপ্তানি বাণিজ্যে বাজার হারাচ্ছে বা সংকুচিত হয়ে আসছে। এ ধরনের নেতিবাচক প্রভাব প্রথম দেখা দেয় উনবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়। বিশ্বে মসলিনের সবচেয়ে বড়ো রপ্তানিকারক ঢাকা, ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে মসলিনের বাজার হারায়। ফলে হাজার হাজার তাঁতি শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। আরেকটি হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির কারণে কর্মসংস্থান কমে যায়। সব নেতিবাচকের প্রভাব পড়েছে আমাদের দেশে। এর সাথে যুক্ত যে সমস্যা তা হচ্ছে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে তথাকথিত সিন্ডিকেট।
এ সমস্যার উত্তরণে অবশ্যই সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার। কিন্তু গভীর বেদনার সাথে বলতে হয় সিন্ডিকেটে জড়িত অনেকেই রাঘববোয়াল যাদের ক্ষমতার হাত একেবারে কেন্দ্রে। অতএব- আমরা একটা চক্রে বন্দি। আর এতে যুক্ত বিশ্বায়ন। যা পৃথিবী জুড়ে অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। অনিশ্চয়তা ও বিশৃঙ্খলাই হচ্ছে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় খেটে খাওয়া মানুষের নিয়তি। একই সাথে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট পুঁজিবাদের আত্মঘাতী প্রবণতায় বাড়ছে ভোগবাদিতা। আর দুযে দুয়ে যখন চার না হয় তখনই অনেক মানুষ হয়ে উঠছে পশুর মতো। বাড়ছে নানা ধরনের সমস্যা।
বিশ্বায়নের স্রোতে আমরা তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নে যান্ত্রিক হচ্ছি কিন্তু লোপ পাচ্ছে মানবিক গুণাবলি। বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করছে আমাদের। হারিয়ে ফেলছি হাজার বছরের ঐতিহ্য। তাই স্টিলগিজের মতে, এর সমাধান হলো বিশ্বায়নের গণতন্ত্রায়ন। রাজনৈতিক অসন্তোষ দূর করতে না পারলে অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের মহা পশ্চাৎপদ ঘটবে।
তবে বিশ্বায়ন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে আমাদের, এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ লর্ড কেইনস বলেছেন- ‘আমি অচল ঘড়ির কাঁটা নই যে এক জায়গায় স্থির থেকে দিনে দুইবার দুই সেকেন্ড সঠিক সময় নির্দেশ করব। আমি একটি সচল ঘড়ি এবং তাই মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন সময় দেখাই।’
তাই আমাদের টিকে থাকতে হলে মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। একই সাথে সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি মানুষের প্রতি এগিয়ে আসতে হবে পরম ভালোবাসায় বিশেষত ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের। মনে রাখতে হবে ক্ষমতার উৎস হচ্ছে জনগণের কল্যাণ, জনগণের ভালো থাকা। নয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিস্ফোরণ ঘটে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়।



















































