রুশো মাহমুদ »
সমুদ্র হচ্ছে সম্পদ। আর এই সমুদ্র সম্পদ নিয়ে যে অর্থনীতি তার নাম ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি। ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রথম উত্থাপিত হয় ব্লু ইকোনমি। যেখানে নানান ধারণা দিয়ে বোঝানো হয়, আগামী দিনের একটি সমুদ্রভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলার কথা। যার উদ্দেশ্য হবে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি পরিবেশের ক্ষতির ঝুঁকিও কমিয়ে আনা। সমুদ্র অর্থনীতির সাথে টেকসই উন্নয়নের প্রসঙ্গটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
সমুদ্র অর্থনীতি ধারণাটির প্রবর্তক হচ্ছেন গুন্টার পাউলি। যিনি একজন উদ্যোক্তা, অর্থনীতিবিদ এবং লেখক। ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য ২০১০ সালে জাতিসংঘ তাঁকে আমন্ত্রণ জানায়। সেখানে একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে তিনি ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন। সমুদ্রের সুনীল জলরাশির অন্তরালে থাকা বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তাঁর ধারণার প্রধান বিষয়। তাঁর ধারণা অনুযায়ী সমুদ্র অর্থনীতিতে, অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সাথে সাথে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে সাধারণ জনগণের সুযোগ-সুবিধা, ভাবতে হবে পরিবেশের কথা, থাকতে হবে উদ্ভাবনী এবং গতিশীল ব্যবসায়িক চিন্তাভাবনা।
বিশ্ব অর্থনীতিতে সমুদ্র নানাভাবেই অবদান রেখে চলেছে। সমুদ্রনির্ভর বিকল্প অর্থনীতির গুরুত্ব বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। জাপান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ বিশ্বেও বেশিরভাগ দেশ বহুদিন ধরে সমুদ্র অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। সিঙ্গাপুরের জিডিপির ৪০ ভাগ সমুদ্রনির্ভর।
ইন্দোনেশিয়া ব্লুু ইকোনমির বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। যার মাধ্যমে ৭৫ হাজার মানুষের নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে এবং প্রতি বছর ১১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের আশা করছে। অস্ট্রেলিয়া সামুদ্রিক সম্পদের উৎকর্ষ সাধন ও পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় করছে। দশ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটির অর্থনীতিতে ব্লুু ইকোনমির অবদান হবে প্রায় ১০০ বিলিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ডলার। গত পাঁচ বছরে চীনের অর্থনীতিতে মেরিটাইম ইন্ডাস্ট্রির অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে যা চীনের মোট জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। দেশটি ব্লুু ইকোনমিকেন্দ্রিক যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে ২০৩৫ সাল নাগাদ জিডিপিতে মেরিন সেক্টরের অবদান হবে প্রায় ১৫ শতাংশ।
সমুদ্র অর্থনীতি পাল্টে দিতে পারে বাংলাদেশকেও। বঙ্গোপসাগর আমাদের শেষ আশ্রয়। এই সাগরকে ঠিকমতো ব্যবহার করা গেলে দেশের জিডিপির প্রবৃদ্ধি অনেক ওপরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশের মালিকানায় রয়েছে বঙ্গোপসাগরের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিশাল এ জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
বাংলাদেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান তার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, এই সম্পদের প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্র তলদেশে রয়েছে।
বাংলাদেশ যে অঞ্চলের মালিকানা পেয়েছে, সেখানে অন্তত চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিবছর প্রায় আড়াই লাখ কোটি মার্কিন ডলার উপার্জন করা সম্ভব। এই ক্ষেত্র চারটি হলো তেল-গ্যাস উত্তোলন, মৎস্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।
পৃথিবীতে কোন কিছু অফুরন্ত নয়। বঙ্গোপসাগরের সম্পদও অফুরন্ত নয়। সীমিত সম্পদের কঠিন বাস্তবাতায় বঙ্গোপসাগর আমাদের আশার আলো। এই সাগরের অনাবিষ্কৃত সম্পদ হবে আমাদের ভবিষ্যতের প্রয়োজনীয় যোগান। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় ক্রমেই আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আবির্ভূত হচ্ছে বঙ্গোপসাগর।
একদিন তেল-গ্যাস ফুরিয়ে যাবে, কারণ এগুলো অনবায়নযোগ্য। কিন্তু অনিঃশেষ রয়ে যাবে গ্রীন এনার্জি বা নবায়নযোগ্য শক্তি। যেমন বায়ু শক্তি, সমুদ্র তরঙ্গ, সমুদ্রস্রোত ইত্যাদি। সাগরের বাতাস কাজে লাগিয়ে উইন এনার্জি এবং তরঙ্গ কাজে লাগিয়ে ওয়েব এনার্জি, জোয়ার ভাটা কাজে লাগিয়ে টাইডাল এনার্জি তৈরি করা সম্ভব হবে। এই এনার্জি কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সহ অন্যান্য নানা উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো যাবে।
বঙ্গোপসাগরে পাওয়া গেছে নানা ধরনের খনিজ বালি। এর মধ্যে রয়েছে ইলমেনাইট, জিরকন, রুটাইল, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, মোনাজাইট, কায়ানাইট ইত্যাদি। অত্যন্ত মূল্যবান এসব খনিজ বালি বিশ্ববাজারে প্রচুর দামে বিক্রি হয়ে থাকে। সাগরের তলা থেকে আহরণ করা সম্ভব খনিজ আকরিক। সেগুলো নিষ্কাশন করলে পাওয়া সম্ভব লেড, জিংক, কপার, কোবাল্ট এবং মলিবডেনামের মতো দুষ্প্রাপ্য ধাতু। মহামূল্যবান এসব ধাতু উড়োজাহাজ নির্মাণ এবং নানা উচ্চতর রাসায়নিক গবেষণাগারে ব্যবহৃত হয়।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় গ্যাস-হাইড্রেটের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সমুদ্রের তলদেশে গ্যাস ও পানির সংমিশ্রণে তৈরি হওয়া স্ফটিককে গ্যাস হাইড্রেট বলা হয়। এটা দেখতে বরফের মতো হলেও এতে প্রচুর পরিমাণে মিথেন থাকে।
উত্তোলনের প্রযুক্তি সহজলভ্য না হওয়ায় অনেক উন্নত দেশ এখনও গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলন শুরু করতে পারেনি। আশা করা যায় অচিরেই এই প্রযুক্তি সহজলভ্য হবে এবং উন্নত দেশের কাছ থেকে প্রযুক্তি নিয়ে গ্যাস-হাইড্রেট উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে বাংলাদেশ।
সমুদ্রসীমা বিজয়ের দশ বছর পরেও প্রস্তুতিতেই সীমাবদ্ধ আমাদের উদ্যোগ। এখন পর্যন্ত সমুদ্রের সম্পদ আহরণে অর্জিত হয়নি তেমন কোনো অগ্রগতি। বঙ্গোপসাগরে ভারত ও মিয়ানমার অংশে তেল-গ্যাস আহরণ কর্মযজ্ঞ দেশ দুটিকে গ্যাসসম্পদে সমৃদ্ধ করেছে। এ ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে রয়েছে বাংলাদেশ। অথচ সাগরের সার্বভৌম অধিকার আদায় এবং জ্বালানি সম্পদে জনগণের শতভাগ মালিকানা সুরক্ষায় বাংলাদেশ তার প্রতিবেশীদের তুলনায় যথেষ্ট তৎপর ও কার্যকর ছিল।
বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যানে সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এই পরিকল্পনায় নীল অর্থনীতির সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পাঁচ ধরনের কৌশল ঠিক করা হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো সামুদ্রিক সম্পদের বহুমাত্রিক জরিপ দ্রুত সম্পন্ন করা। গত দশ বছরে সমুদ্রসম্পদ নিয়ে কিছু গবেষণা হয়েছে। এর বাইরে সভা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ছাড়া সম্পদ আহরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বিপুল সম্ভবনাময় এই সমুদ্র অর্থনীতিতে আমরা এখন পর্যন্ত যথাযথ মনযোগ দিতে পারি নাই। যেটুকু অগ্রগতি তা এতটাই ধীর গতির যে তাকে নামমাত্রই বলা চলে।
বঙ্গোপসাগরের অপার সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের জানাটা খুবই নগণ্য। এই বিশাল অঞ্চলে কী পরিমাণ মৎস্য ও খনিজ সম্পদ রয়েছে, সে সম্পর্কে এখনও কোন পরিস্কার ধারণা নেই। যদি এসব মূল্যবান সম্পদ উত্তোলন ও আহরণ সম্ভব হয়, তবে আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা নিঃসন্দেহে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশের সামনে রয়েছে সুবর্ণ সুযোগ। আমাদের দরকার বিস্তৃত গবেষণা এবং অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ জনবল। পাশাপাশি যথোপযুক্ত নীতি সহায়তা ও দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ। যেসব দেশ ব্লু ইকোনমিতে এগিয়ে আছে প্রযুক্তি ও বিনিয়োগ সহায়তা পেতে সেই দেশগুলোর সাথে করতে হবে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি। সমুদ্র অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগাতে হলে বাংলাদেশকে নিজস্ব সক্ষমতাও বাড়াতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদায় উন্নীত হতে দেশকে এগিয়ে নেবে সমুদ্র অর্থনীতি। সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে সুনীল অর্থনীতি।