ডা. শেখ শফিউল আজম »
কোভিড-১৯ মহামারি সমগ্র বিশ্বকে ল-ভ- করে দিয়েছে। এমনিতে বিশ্বে ২/৩ শ কোটি মানুষ নানাভাবে দারিদ্র্য, দুর্যোগসহ নানা বিরূপ পরিস্থিতির শিকার। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সমগ্র বিশ্বের অস্তিত্বকেই আজ বিপন্ন করে তুলেছে। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিস্থিতি দরিদ্র অনুন্নত দেশগুলোকে গভীর সংকটে ফেলেছে। ধনী বড় দেশগুলোর শিল্প কারখানাগুলো থেকে নিঃসৃত কার্বন নিঃসরণ সব দেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। ফলে প্রকৃতি দিন দিন রুক্ষ ও আগ্রাসী হয়ে উঠছে। অতি বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড়, হ্যারিকেন, বন্যা, খরা, নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ব মানবতা আজ বিপন্ন। উষ্ণায়নের জন্য অনুন্নত দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলো দায়ী না হলেও ওরাই আজ এর করুণ শিকার। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জলবায়ু তহবিলে আর্থিক জোগান দিতে ধনী বড় দেশগুলোর প্রতি বারবার আহ্বান জানিয়েছেন।
একদিকে কোভিড-১৯ মহামারির বিশ্বজুড়ে ক্রমবিস্তার মানুষকে অসহায়ত্বের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই ১৫ মাসে সারা বিশ্বে ছত্রিশ লাখ মানুষ করোনার ছোবলে বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছে। বিশ্বে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পঁয়ত্রিশ কোটির বেশি মানুষ। প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোতে প্রতি বছর লাখো লাখো মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। তবে আশার কথা যে, নানা দুর্যোগের শিকার বিপন্ন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে রেড ক্রস, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি। বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এ সোসাইটি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়াও যুদ্ধ সংঘাতে বিপন্ন দুর্দশাগ্রস্ত শরণার্থীদের পাশেও দাঁড়াচ্ছে এ আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুঃখ দুর্দশার শিকার মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়া তথা ত্রাণ ও রিলিফ সামগ্রী বিতরণ, তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দেয়ার দায়িত্বই পালন করছে এ সোসাইটি। ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস- আইসিআরসি এই বেসরকারি মানবতাবাদী প্রতিষ্ঠান ১৯১৭, ১৯৪৪ এবং ১৯৬৩ সনে তিনবার নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিজ- আইএফআরসি ১৯১৯ সনে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় ১৯৩টি দেশ এই সংস্থার কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশেও রেড ক্রস কার্যক্রম থেমে ছিল না। ৩১ মার্চ ১৯৭৩ সনে দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি অধ্যাদেশ (পিউ ২৬) জারি করেন। এই আদেশের বলে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সন থেকে ‘বাংলাদেশ রেডক্রস সোসাইটি’ স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৮৮ সনে রেড ক্রসের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি রাখা হয়। আমি ২০০৯ সনে চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে চেষ্টা করছি দুর্দশাগ্রস্ত মানবতার পাশে দাঁড়াতে। এখন রেড ক্রিসেন্ট চট্টগ্রাম জেলা কমিটির কার্যক্রম বিস্তৃত হয়েছে। জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট মাতৃসদন হাসপাতাল, রেড ক্রিসেন্ট জুনিয়র মিডওয়াইফারি ইনস্টিটিউট, জেমিসন রেড ক্রিসেন্ট নার্সিং ইনস্টিটিউট, ফাতেমা বেগম ব্লাড ব্যাংক ও থেলাসেমিয়া সেন্টারসহ বহু কার্যক্রম চলছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি চট্টগ্রাম জেলা ইউনিটের ব্যবস্থাপনায়। এছাড়াও আছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এতে কম খরচে গরিব রোগীরা নানা ধরনের চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। রেড ক্রিসেন্টের পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে বারো হাজার ফুট জায়গায় বারো তলা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে সিডিএ। বর্তমান পুরাতন ভবনগুলোতে স্থান সংকুলন না হওয়ায় নতুন ভবন নির্মাণ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমাদের বিশাল যুব স্বেচ্ছাসেবক টিম রয়েছে। যারা এই কোভিড কালীন সময়ে জীবনবাজি রেখে ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে অসহায় দুস্থ মানুষের মাঝে তৈরি খাবার বিতরণ, রমজানে ইফতারি বিতরণ, ফ্রি মাস্ক বিতরণ, চিকিৎসকদের মাঝে পিপিই তথা স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদান, প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রদান, রোগীদের জন্য বিনামূল্যে ওষুধ বিতরণসহ নানা মানবিক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ কোভিডকালীন সময়ে আমাদের ত্রাণ সহায়তা ও মানবিক কার্যক্রমের পরিধি সারা বিশ্বে দিন দিন প্রশংসিত হচ্ছে। বাংলাদেশ শুধু নয়, বিশ্বের নানা দেশে দুঃখ দুর্দশা ও মানবিক বিপর্যয়ের শিকার অসহায় বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে রেড ক্রস সোসাইটি।
আমেরিকা ব্রিটেন ইতালি ব্রাজিল তো বটেই এমনকি আমাদের পাশের বড় দেশ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে করোনার নতুন ধরন দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিন শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটছে। ভারতের ডাবল মিউট্যান্ট আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই সম্প্রতি ট্রিপল মিউট্যান্ট আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে ভারতের চারটি রাজ্যে নতুন নাইজেরিয়ান ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। ভারতে যে দুটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে তা সারা বিশ্বে বিরল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন কোভিড ১৯ ভাইরাসের তিনটি আলাদা স্ট্রেইন মিলে তৈরি হয় এই নতুন ভ্যারিয়েন্ট। এই ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণের ক্ষমতাও কয়েক গুণ বেশি হয়ে থাকে। ভারত আমাদের পাশের দেশ হওয়ার কারণে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি বাংলাদেশের জন্যও বিপদ ডেকে আনতে পারে। আমাদের দেশে ডাবল বা ট্রিপল মিউট্যান্ট ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি আছে কিনা তা নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্সিং গবেষণা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইইডিসিআর জরুরিভাবে এ কাজ করছে। আমাদের দেশে এখন তীব্রভাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় ঢেউ এখন দ্বারপ্রান্তে। এখানেও যদি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট আঘাত হানে তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেবে। তখন তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই ভারতে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে সীমান্তে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। ভারতীয় নতুন ভেরিয়েন্ট যাতে এদেশেও ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা জরুরি। করোনার সংক্রমণ থেকে বাঁচতে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধুইতে হবে। ইতিমধ্যে সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষকে করোনার ভ্যাকসিন দিয়েছে। আরো টিকা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে। দেশেই ভ্যাকসিন তৈরির কার্যক্রমও শুরু হচ্ছে বলে সরকারি তরফে জানা গেছে। সমগ্র মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। শুধু সরকার একার পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। জীবন ও জীবিকা দুটোই সমন্বয় করতে হবে। একটু কষ্টকর হলেও সরকারি নির্দেশনা সবাইকে মেনে চলতে হবে। দেশে অক্সিজেন বা আইসিইউতে হাইফ্লো নেজাল কেনুলার অভাবে একজন মানুষের মৃত্যুও যেন না হয় সে দিকে আমাদের নজর রাখতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি কিছু শিল্প গ্রুপ অক্সিজেন ও সিলিন্ডার সরবরাহ করায় করোনা আক্রান্তদের আরও ব্যাপকভাবে চিকিৎসাসেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে। গত বছরের মার্চ মাস থেকেই করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হলে চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির উদ্যোগে আমরা নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করি। অক্সিজেন ও সিলিন্ডার সরবরাহ করার পাশাপাশি মাস্ক, স্প্রে, সাবান ও চিকিৎসকদের মাঝে পিপিই ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী প্রদানে আমরা এগিয়ে আসি যা এখনো চলমান রেখেছি। চট্টগ্রামের অলিগলিতে গরিবদের মাঝে শাকসবজি, ইফতার সামগ্রী ও শুকনো খাবার বিতরণ করছি আমরা। ইনশাআল্লাহ আগামী দিনেও তা অব্যাহত রাখা হবে।
দুই তিন বছর আগে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট সৃষ্টি হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কার্গো বিমানসহ বিভিন্নভাবে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সহায়তা আসতে থাকে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের জন্য বিদেশ থেকে আসা ত্রাণ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে আসছে। যাবতীয় ত্রাণ তথা রিলিফ চট্টগ্রাম হয়ে আমাদের মাধ্যমে কক্সবাজারে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিটি দুর্যোগ দুর্বিপাকে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি সবসময় বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে।
বর্তমানে চলছে করোনাকাল। দেশে প্রায় তেরো হাজার মানুষ করোনার ছোবলে প্রাণ হারিয়েছে। প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। যা আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। আজ বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। এ মূহূর্তে আমাদেরকে বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। যারা চিকিৎসার অভাবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছে, তাদের প্রতি আমাদেরকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আপনার চারপাশের অসহায় মানুষের মাঝে প্রসন্ন দৃষ্টি দিন। পরিচ্ছন্ন জীবন যাপন করুন। নিজে বাঁচুন, অন্যকেও বাঁচতে দিন। বর্তমান করোনার এই দুঃসময়ে জীবনবাজি রেখে ফ্রন্ট ফাইটার হিসেবে সামনের কাতারে থেকে চিকিৎসকরা মানবিক সেবা দিচ্ছেন করোনা রোগীদের। চট্টগ্রামের জনপ্রতিনিধিগণ, বিভাগীয় প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, স্বাস্থ্য প্রশাসন, জেলা সিভিল সার্জন, বিএমএ, স্বাচিপ, পুলিশ, র্যাব সহ যারাই দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন সকলের প্রতি জানাই অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আশা করি সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় একদিন আমরা করোনা মোকাবেলায় সক্ষম হবো ইনশাআল্লাহ।
লেখক : চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ। ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বি.এম.এ),
ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান: বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট।