ড. শ্যামল কান্তি দত্ত »
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তখন মাত্র বাইশ বছরের তরুণ; ১৯২১-এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো এক রাতের শেষপ্রহরে কলকাতায় এক মেসে তিনি পেনসিলে লেখেন বাংলা সাহিত্যের বিপুল প্রভাববিস্তারী ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (প্রতিষ্ঠা : জুলাই ১৯২১) বয়স তখন মাত্র পাঁচ মাস। পাঁচ বছরের মাথায় এই বিশ্ববিদ্যালয়েই গড়ে ওঠে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র ‘শিখা’ (১৯২৫) এবং ঠিক পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে প্রথম উড্ডীন হয় একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের লালসবুজ পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। আর তাই এই শত বছরে বাংলার সাময়িকপত্রে-পুস্তকে ও সেমিনারে নজরুল সম্পর্কে যত বিস্তর বলা হয়েছে, তাঁকে নিয়ে যত বই লেখা হয়েছে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত তত আর কারো ওপর হয়নি। বাঙালি নজরুল নিয়ে বিস্তর বলেছে বটে তবে তাঁর সমগ্র স্বরূপের সন্ধান আজও অনেকটা অচেনা। নজরুলের কবিতা পড়ে বাঙালি উদ্দীপিত হয়ে বিপ্লবী হয়েছেÑ ভাষা আন্দোলনে-মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার জয়ধ্বনি করেছেÑ বাঙালির জয় ছিনিয়ে এনেছে। অথচ নজরুলকে তাঁরা খণ্ডিত অর্থে প্রেমের কবি কিংবা ধর্মসংগীতের গীতিকার প্রমাণে মরিয়া। এমনকি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা নিয়ে বিপরীত বক্তব্যও বিদ্যমান।
কারো মতে, বাংলা ভাষার জনপ্রিয়তম কবিদের শীর্ষে থেকেও সবচেয়ে সহজবোধ্য নন যিনি, তাঁর নাম নজরুল। কেউ মনে করেন হিন্দু-মুসলিম, গ্রিক পুরাণাশ্রিত চিত্রকল্পের পৌনঃপুনিক ব্যবহারে কবিতাটি প্রতীকধর্মী হয়ে উঠলেও এটির বক্তব্য দুরূহ নয়। বিশেষত কবিতার বীরসত্তা কিংবা উত্তম পুরুষের চারিত্র্য নির্ণয়ের সাথে সাথেই কবিতাটি হয়ে ওঠে সহজবোধ্য। পদাবলী-কীর্তন, শ্যমাসংগীত, গজল, হামদ-নাত, গল্প-উপন্যাস-নাটক ও অভিভাষণ যত কিছুই নজরুল লেখেন না কেন ‘বিদ্রোহী’ অভিধা থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। ‘বিদ্রোহী’র এই তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ সমকালীন মুক্তি-আকাক্সক্ষী মানুষের প্রতিবাদী আবেগকে তা যথাযথভাবে ধারণ করেছিল। আর এতে প্রতিফলিত হয়েছিল নজরুলের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিভার সর্বময় দীপ্তি। নজরুল-প্রতিভার মৌল প্রবণতা তথা প্রাণভোমরারও উৎসবিন্দু হয়ে আছে এ কবিতা। তাই কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতার ভাষা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই সামগ্রিকভাবে নজরুলকে চেনা সম্ভব।
‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি একরাতে লেখা বলা হলেও সাহিত্যিক মাত্রই জানেন কবিতার একটি পঙ্ক্তি কবির অন্তরে অনেকদিন ধরে অনুরণিত হতে থাকে। অনেক সময় সারাজীবন অপেক্ষা করেও কবি তাঁর কাক্সিক্ষত পঙক্তিটি হয়তো লিখতেই পারলেন নাÑ শুধু জন্মবেদনা বহন করেন আজীবন। অনেক সময় অল্প কদিনের মধ্যেই পুরো কবিতা কবির কাছে ধরা দেয়। তাই কবিতাটি কবির অন্তর্লোকে প্রস্তুতির প্রকৃতি জানতে ‘বিদ্রোহী’ রচনার সমকাল এবং তার আগেকার নজরুল-জীবনে দৃষ্টিপাত করা আবশ্যক।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)