অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি
সুপ্রভাত ডেস্ক
বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করে নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা না-দেয়া কিংবা সরকারকে সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, ইউটিলিটি বিল এবং অন্যান্য প্রদেয় স্থগিত করার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা দলের ভেতরেই অনেককে বিস্মিত করেছে।
হুট করে সরাসরি অসহযোগের মতো কর্মসূচি ঘোষণাটি ‘সময় আসার আগেই’ হয়ে গেছে কি-না তা নিয়ে দলটির ভেতরে বাইরে নানা আলোচনা হচ্ছে। খবর বিবিসি বাংলা।
দলের বিভিন্ন পর্যায়ে একাধিক নেতা জানিয়েছেন সাধারণত সরকার বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি যাদের সাথে আলোচনা করে চূড়ান্ত করা হয় অসহযোগ কর্মসূচির ক্ষেত্রে সেটি হয়নি। বরং এটি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান একক সিদ্ধান্তেই লন্ডন থেকে ঘোষণা করেছেন।
যদিও মি. রহমানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলছেন কর্মসূচি যথাসময়েই এসেছে বলে তারা মনে করেন।
‘অসহযোগের কর্মসূচির ঘোষণার পর তা বাস্তবায়নে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেও আলাদা কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।আমরা বিশ্বাস করি ধীরে ধীরে জনগণ সরকারকে অসহযোগিতার এই ‘সিভিল কর্মসূচি’টি পালন করতে শুরু করবে’, বলছিলেন তিনি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. রাশেদা রওনক খান অবশ্য বলছেন রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার জন্য বিএনপি হয়তো এমন কর্মসূচি দিয়ে চমক দিতে চেয়েছে।
‘এটি সত্যি আদালতে হাজিরা না দেয়া বা কর, বিল, খাজনা না দেয়ার বিষয়গুলো বাস্তবসম্মত নয়। বিএনপি হয়তো রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে দিয়েছে। তবে দেশে থাকা দলটির নেতাকর্মী ও সমর্থকদের জন্য এসব বিষয় এড়িয়ে চলা সহজ কাজ হবে না,’ বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, বুধবারই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে অসহযোগের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। পরে তাকে উদ্ধৃত করে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে কর্মসূচিটির আবার ঘোষণা দেন।
বিএনপিতে বিস্ময়, সবাই নিশ্চুপ
বিএনপির মাঠ পর্যায়ের বেশ কয়েকজন নেতার সাথে এ বিষয়ে বিবিসির কথা হয়েছে। দলীয় পদ-পদবী থাকায় তারা অন রেকর্ড কোনও কথা বলতে চাননি।
তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে মানিকগঞ্জের একজন বিএনপি নেতা বলেছেন, ‘নেতারা কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে তারাই বলতে পারবেন। তবে এখনি অসহযোগ না দিয়ে তার আগে সবার কারাবরণ কর্মসূচি দিলে তা বেশি কাজে লাগতো।’
‘আমাদের অসংখ্য নেতা কর্মী জেলে। আমরাও যেতাম। একযোগে কারাবরণ করতাম। এখন কর খাজনা কিংবা বিল না দিয়ে কয়জন পরিস্থিতি সামলাতে পারবে?’, বলছিলেন তিনি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে যে ধারণা পাওয়া গেছে তা হলো এই কর্মসূচি অনেকটাই এককভাবে লন্ডন থেকে এসেছে।
ঢাকায় দলের নেতাদের ধারণা ছিলো ধীরে ধীরে এমন কর্মসূচির দিকেই হয়তো দল যাবে কিন্তু সেটি এতো দ্রুত ও হুট করেই ঘোষণা করা হবে সেটি তারা ভাবেননি।
এমনকি বিএনপির সঙ্গে যেসব দল ও জোট অনেকদিন ধরেই যুগপৎ আন্দোলনে আছেন তাদের কেউ কেউ আগে থেকে জানলেও অনেকেই বিষয়টি ঘোষণার পর জেনেছেন।
তবে বিএনপির কেউ কেউ বলছেন অসহযোগ, পরিষেবা বিল কিংবা ট্যাক্স বা খাজনা দেয়ার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভাবে বললেও এসব বিষয়ে কিছু কৌশল আছে।
যেমন বিএনপির ঘোষণায় জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংকগুলো এই অবৈধ সরকারের লুটপাটের অন্যতম মাধ্যম। সুতরাং, ব্যাংকে টাকা জমা রাখা নিরাপদ কি না সেটি ভাবুন।’
তবে প্রকৃত তথ্য হলো বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে ব্যাংক মালিক-পরিচালকও আছেন। এছাড়াও দলের নেতাদের অনেকেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তাদের পক্ষে ব্যাংক এড়িয়ে চলা অনেকটাই অসম্ভব।
এর বাইরে দলটির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরাও ব্যাংকে টাকা জমা রাখা থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে কতটা সাড়া দেবেন, সে প্রশ্ন আছে দলের ভেতরেই।
কায়সার কামাল বলছেন এটি বলা হয়েছে কারণ দেশের মানুষ ব্যাংকগুলো ও অর্থনীতির ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে অবগত।
‘সে কারণেই আমরা সতর্ক করে বলেছি যে এখন এসব ব্যাংকে মানুষ তার কষ্টার্জিত টাকা রাখবে কি না সেটা যেন তারা ভেবে দেখে,’ বলছিলেন মি. কামাল।
আবার বিএনপির ঘোষণায় তাদের ভাষায় ‘মিথ্যা ও গায়েবি মামলায়’ অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও অন্যদের আদালতে মামলায় হাজিরা দেয়া থেকে বিরত থাকার আহবান জানানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ওই ঘোষণার পরদিন আজ বৃহস্পতিবারও নিম্ন আদালতে ২০১২ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় দলটির অনেক নেতাকর্মী হাজিরা দিয়েছেন।
‘সবাই এখন জানে তারা আর ন্যায় বিচার পাবে না এ সরকারের আমলে। আমাদের বহু নেতাকর্মী কারাগারে, অনেককে একতরফাভাবে সাজা দেয়া হয়েছে। তাই হাজিরা দিয়ে লাভ কী? বিএনপি সেটিই বলতে চেয়েছে”, বলছিলেন কায়সার কামাল।
কর্মসূচিতেও কৌশল আছে
বিএনপির কয়েকজন নেতা অবশ্য বলেছেন অসহযোগের সাথে যেসব কর্মসূচি দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে কৌশলও আছে।
যেমন কর্মসূচিতে সরাসরি ব্যাংকিং কার্যক্রম এড়িয়ে চলতে বা বাদ দিতে বলা হয়নি। বলা হয়েছে ব্যাংকে টাকা জমা রাখা কতটা নিরাপদ সেটি চিন্তা করতে।
আবার গ্যাস, বিদ্যুৎ-সহ পরিষেবা বিলগুলো তিনমাস পর্যন্ত জমা না দিলে তেমন কোনও সমস্যা হয় না। এখন তিন মাস না দিয়ে লোকজন পরে জরিমানা সহ পরিশোধ করার সুযোগ পাবে এবং এতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়।
আর আদালতে হাজিরা না দেয়ার কথা বলা হয়েছে কারণ দলটির বেশির ভাগ সক্রিয় নেতাই এখন জেলে এবং বিভিন্ন মামলায় অনেকের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আর অল্প কিছু নেতা দণ্ড মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, যারা হাজিরা দিতে আসলেই জেলে চলে যেতে হবে।
‘সম্ভবত এ কারণেই আর কাউকে হাজিরা না দেয়ার কথা বলা হয়েছে,’ বলছিলেন দলটির একজন নেতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাশেদা রওনক খান বলছেন কর্মসূচি দেখে তার মনে হয়েছে বিএনপি কিছুটা চমক দিতে চেয়েছে। ‘বিএনপি হয়তো ভেবেছে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই আকর্ষণীয় কর্মসূচি দিয়ে তারা রাজনীতির মাঠে থাকতে চেয়েছে।’
‘কিন্তু তারা যে সব নির্দেশনা দিয়েছে সেগুলো হয়তো বাস্তবসম্মত হয়নি। এর কারণ হতে পারে এই কর্মসূচির ক্ষেত্রে হয়তো খুব বেশি ভাবেননি তারা। কীভাবে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে সেটিই হয়তো বেশি চিন্তায় এসেছে,’ বলছিলেন তিনি।
তবে কায়সার কামাল বলছেন আগামী কয়েকদিন মানুষকে এসব বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করতে মাঠে নামবে বিএনপি।
‘একতরফা নির্বাচন করে দেশকে ভয়ংকর সংকটে ফেলে দিচ্ছে সরকার। ব্যাংকগুলো অচল হয়ে গেছে লুটপাটের কারণ। কোথাও কেউ ন্যায়বিচার পাচ্ছে না। সেবা নাই কিন্তু বিল, কর ও খাজনা দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে,’ বলছিলেন তিনি।
তিনি জানান আগামী কয়েকদিন বিএনপি এসব বিষয়ই মানুষের কাছে তুলে ধরবে ও বলবে সরকারের পতনই এ অবস্থার একমাত্র সমাধান বলে তারা মনে করেন।