সনজিত দে :
প্রকৃতির রঙে গড়া শস্য শ্যামল সবুজ ঘেরা সারি সারি গাছপালা ছোট বড় ঘরবাড়ি ও পাখিদের মধুর কলতানে মন ভরে যায়। শুভপুরের উত্তরে বরইয়া গ্রাম। সেই গ্রামের এক দুরন্ত ছেলে বাপ্পী। সবাই তাকে এক নামে চেনে।
তার লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি শুধু দুরন্তপনার জন্য। তার কাজ হল স্কুল ফাঁকি দিয়ে গাছের কোটরে বই রেখে বনবাদাড়ে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো। কোথায় পাখির বাসা, কোন বাসায় পাখি ডিম পেড়েছে। কোন বাসায় পাখি বাচ্চা ফুটিয়েছে এগুলো নিয়েই তার দিন কাটে।
একদিন ভরদুপুরে বাপ্পী আনমনা হয়ে শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে বসে কী যেন ভাবছে। হঠাৎ চোখ ফেরাতে দেখতে পেল দুটি কোয়েল পাখি উড়ে এসে তেঁতুল গাছের পাতার আড়ালে ঢুকে পড়ল। কিন্তু কোয়েলগুলো অনেকক্ষণ পর্যন্ত বের হচ্ছে না দেখে মনের কৌতূহলে সেই গাছে উঠতে হঠাৎ কোয়েল দুটো বুঝতে পারলো যে গাছে কেউ উঠেছে। ফুড়–ত করে উড়ে চলে গেলো। দেখে বাপ্পীর বুঝতে অসুবিধা হল না এখানে নিশ্চয়ই কোয়েলের বাসা।
কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর দেখতে পেল খড়কুটোয় ঘেরা একটি ছোট্ট বাসা। বাসায় দুটো ডিম। ডিমগুলো দেখে হাত দিয়ে নাড়াচড়া করে বাসায় রেখে বাপ্পী নেমে পড়লো গাছের নিচে।
রোজ বাপ্পী পুকুর ঘাটে এসে পাখির বাসা পাহারা দেয়। যখন কেউ থাকতো না পুকুরের আশেপাশে অমনি ঝটফট গাছে উঠে ডিমগুলোর অবস্থা দেখেই নেমে পড়ে। এভাবে কয়েক দিন অপেক্ষার পর একদিন দেখতে পেলো বাসায় দু’টো ফুটফুটে বাচ্চা। দেখেই বাপ্পীর মন জুড়িয়ে গেলো। বাচ্চা দু’টোকে বাপ্পী আদর দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো এবং গায়ের গেঞ্জি খুলে এক পাশে গিট দিয়ে থলে বানিয়ে আলতো করে পাখি দুটোকে ভেতরে বসিয়ে খুব সাবধানে নেমে পড়লো। বাড়িতে গিয়ে একটা খাঁচার ব্যবস্থা করে সেখানে বাচ্চা দু’টোকে রাখলো। চালের খুদ একটা ছোট পাত্রে তাদেরকে খেতে দিল সাথে একটি পানির পাত্রও দিল।
খাঁচার ভেতর কোয়েলের বাচ্চা দু’টি আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। বাপ্পী একদিন ভাবলো কোয়েল দু’টি এখন বেশ বড় হয়েছে। ছাড়া পেলে উড়তে পারবে। খাঁচার ভেতর ডানা মেলতে চেষ্টা করে। কিন্তু তারা তো বন্দি কীভাবে উড়বে। আমিতো তাদের বন্দি করে রেখেছি। না, এটা উচিত হয়নি আমার। এ রকম হাজারো ভাবনা অস্থির করে তোলে বাপ্পীকে। তাই সে ঠিক করলো বাচ্চাগুলোকে ছেড়ে দেবে। এ মনে করে তেঁতুল গাছে উঠে কোয়েলের বাসাটি খুঁজলো অনেকক্ষণ। কিন্তু সেখানে কোনো পাখির বাসার চিহ্ন পর্যন্ত নাই।
সে নিজেকে অপরাধী ভাবতে লাগলো। কোয়েলদের মা বাবা বাচ্চাদের হারিয়ে ভীষণ মন খারাপ করে চলে গেছে। আবার ভাবতে লাগলো কী করি, কী করি এদের নিয়ে-এক্ষুনি ছেড়ে দেব। না আরও কিছুদিন পর। তখন সে কোয়েল দু’টির যতœ আগের চেয়ে বাড়িয়ে দিল ভালো ভালো খাবার খাইয়ে কিছুটা শিকারি করে তুলল।
এরই মধ্যে একটা অঘটন ঘটে গেল। একদিন সন্ধ্যায় বাপ্পী ভুলে গেল খাঁচার দরজা বন্ধ করতে। এই সুযোগে দুষ্টু হুতুম পেঁচা কোয়েল দু’টিকে আক্রমণ করল। একটি উড়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও আঘাতের চিহ্ন গায়ে দেখা গেল। ডানা ছিড়ে রক্ত ঝরছে। অন্যটিকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। আহত কোয়েলটিকে কাঁচা হলুদ গরম করে ক্ষতস্থানে বেঁধে সুস্থ কর তুলল। পুরোপুরি যখন সুস্থ হল তখনি সে কোয়েলটিকে ছেড়ে দিলো। ছাড়া পেয়ে ফুড়–ত করে উড়ে চলে গেলো চোখের আড়ালে। বাপ্পী ফিরে এলো বাড়িতে।
কিন্তু আজ তার মন কেমন যেন হয়ে গেছে। কোনো কিছুতে আর মন বসছে না। এতদিন যে কোয়েল তার সাথে ছিল আজ তাকেও ছেড়ে গেল। দিন ফুরিয়ে সন্ধ্যা হল। বাপ্পী প্রতিদিনের মতো খাঁচাটা নাড়াচাড়া করতে লাগল। কিন্তু কী আশ্চার্য কোয়েলটি ফিরে এসেছে এতদিনের পুরনো বাসায়। জায়গা মতো খাঁচাটি না থাকায় সারা রাত ঘরের চালে রাত কাটিয়েছে। রাতে বাপ্পীর একদম ঘুম হল না। ঘরের চালে যেন ঝুপঝুপ কীসের নড়াচড়া। কিন্তু রাতে সে বের হল না। ভোরের আলোয় দেখতে পেল তার শখের কোয়েলটি খাঁচা না পেয়ে ঘরের চালে বসে আছে দেখে প্রথমে সে বিশ্বাসই করতে পারলো না। আসলে পাখি হলেও কোয়েলটি বাপ্পীর মায়াজালে জড়িয়ে গেছে।