বিবিসি বাংলা »
বাংলাদেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ পদগুলো আগে বিদেশিদের জন্য এক প্রকার সংরক্ষিত থাকলেও গত দুই দশক ধরে সেই ধারায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ, ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে অর্ধশতাধিক বহুজাতিক কোম্পানির নেতৃত্ব দিয়ে আসছে বাংলাদেশিরা।
এরমধ্যে রয়েছে গ্রামীনফোন, রবি, ব্রিটিশ অ্যামেরিকান টোব্যাকো, ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস, এইচএসবিসি, মাস্টারকার্ড, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ল্যাকোস্টে, স্ন্যাপচ্যাট, ইন্টেলসহ বিভিন্ন নামীদামী প্রতিষ্ঠান।
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রসার, নেতৃত্বগুণের চর্চা সেইসঙ্গে অভ্যন্তরীণ বাজার এবং চাহিদা সম্পর্কে বিদেশিদের চাইতে বাংলাদেশিদের সঠিক ধারণা থাকাকে এর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সক্ষম যোগ্যতা
যোগ্যতার প্রশ্নে যারা সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছেন শুধুমাত্র তাদেরকেই ওই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রধান নির্বাহী (সিইও) বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে বলে জানান বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুপালি চৌধুরী।
তিনি ২০০৮ সাল থেকে এই কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে আছেন।
তিনি জানান, শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিক বলে নয়, বরং যেসব প্রার্থী সাফল্যের সাথে যোগ্যতার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করে নিজেদের সক্ষমতার প্রমাণ করতে পেরেছেন, শুধুমাত্র তাদেরকেই নিয়োগ করা হয়েছে।
নিয়োগ দেওয়ার আগে মূলত দেখা হয় যে ওই প্রার্থীর অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাজার সম্পর্কে ধারণা কেমন।
আগে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানে কোন পদে কাজ করেছেন। সেখানে তার পারফর্মেন্স, অভিজ্ঞতা, প্রশিক্ষণ, শিক্ষাগত যোগ্যতা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, যোগাযোগ ও নেটওয়ার্কিং সবকিছু যাচাই বাছাই করেই নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
নেতৃত্বের শিক্ষা
বাংলাদেশে বহু প্রতিভাবান তরুণ আছেন যাদের বহুজাতিক কোম্পানিকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা আছে।
এবং এই যোগ্যতাসম্পন্ন ইয়াং প্রফেশনালদের মধ্যে যারা বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বড় পদে কাজ করছেন তাদের একটি বড় অংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট- আইবিএ এর শিক্ষার্থী বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক এবং আইবিএর শিক্ষক মো. আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল লিডারশীপ তৈরি লক্ষ্য নিয়েই ৫৫ বছর আগে আইবিএ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।
সে লক্ষ্য অর্জনে এই দীর্ঘ সময় ধরে ইন্সটিটিউটটি শিক্ষার্থীদের যাচাই বাছাই করে আসছে এবং পাঠ্যসূচি সেভাবেই সাজানো হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের এই নেতৃত্বগুণ শেখানো হয়েছে বলেই, কর্মক্ষেত্রে এখন এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে বলে জানান মি. মোমেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশে বহুজাতিক পেশাদার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপারস পিডব্লিউসি’র ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ মনে করেন, বাংলাদেশে ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের বিকাশের ফলে সম্প্রতি অধিক হারে শিক্ষার্থীরা বিদেশি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিয়োগ পাচ্ছেন।
তাদেরকে বাংলাদেশে কাজ করানোর পাশাপাশি বিদেশে পেশাগত প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে যেন তারা নেতৃত্ব দিতে পারে।
বিগত কয়েক বছর ধরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের কর্মকর্তাদের বিদেশেও কাজে নিয়োজিত করছে যাতে তারা বহির্বিশ্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা নিতে পারে।
সংস্কৃতির সাথে খাপ খাওয়ানো
বাংলাদেশের বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় সাধারণত দুই-তিন বছর মেয়াদে শীর্ষ পদে বিদেশিদের নিয়োগ দেয়া হয়।
দেখা যায়, ওই বিদেশি নেতাদের একটি দীর্ঘ সময়, স্থানীয় বাজার সম্পর্কে ধারণা নিতে এবং স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতি সঙ্গে খাপ খাওয়াতেই চলে যায়।
অথচ যোগ্যতাসম্পন্ন কোন বাংলাদেশি নেতৃত্বে থাকলে এর পেছনে তাদের বাড়তি সময় ব্যয় করতে হয় না।
শুরু থেকেই দেশের বাজার, ভোক্তাদের চাহিদা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা থাকায় স্থানীয় নিয়ন্ত্রকদের সাথে যোগাযোগ করা ও নেটওয়ার্কিং করা বাংলাদেশিদের পক্ষে সহজ হয়।
যা সামগ্রিক সুফল বয়ে আনে বলে জানান রুপালি চৌধুরী।
খরচ কমানো
এছাড়া বিদেশিদের নিয়োগ দিতে গেলে তাদের নিজ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে কাজ করার জন্য বেতনের পাশাপাশি বাড়তি ভাতা দিতে হয়,
কিন্তু বাংলাদেশি কাউকে নিয়োগ দেয়া হলে এমন কোন বরাদ্দ লাগে না। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সেই খাত বাবদ বিপুল পরিমাণ খরচ কমাতে পারে।
বাংলাদেশে থাকার সুযোগ
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক, সামাজিক প্রতিটি সূচকে কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছে।
রুপালি চৌধুরী মনে করেন, বাংলাদেশে ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ দিন দিন বাড়ছে। এখানে ভবিষ্যত সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠায়, যোগ্যতাসম্পন্নরা নিজ দেশেই শীর্ষ পদে ভবিষ্যত গড়তে আগ্রহী। কারণ নিজের দেশে পরিবার পরিজন নিয়ে থাকার একটি সুবিধা আছে।
আবার যারা দেশে নিয়োগ পান তারা সহজেই স্থানীয় সংস্কৃতিটা বোঝেন সেইসঙ্গে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও দক্ষ হয়ে ওঠেন।
এভাবে একটি প্রতিষ্ঠান যখন বিদেশিদের পরিবর্তে বাংলাদেশিদের নিয়োগ দেয় তখন সেটা দেখাদেখি অন্যান্য কোম্পানিগুলো চেষ্টা করে যোগ্যতাসম্পন্ন বাংলাদেশিদের খুঁজে বের করে নিয়োগ দিতে।
মূলত যারা নিজেদের কর্মদক্ষতার পরিচয় দিতে পারেন এবং সেটার প্রতিফলন কাজে দেখাতে পারেন, তারাই নিয়োগ পান।- বলেন মিস চৌধুরী।
ভারতেও চিত্রে এক সময় এমনটাই ছিল। পরবর্তীতে তারা বিদেশিদের সরিয়ে নিজ দেশের কোম্পানিগুলোর উঁচু পদে নিজেদের নাগরিকদের নিয়োগ দেয়া শুরু করে।
এ ব্যাপারে মিস চৌধুরী বলেন, “বাংলাদেশের শীর্ষ পদে বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণ বাড়াতে স্থানীয় মেধাবীদের প্রমোট করতে হবে, উৎসাহ দিতে হবে, সুযোগ দিতে হবে। তারা নিজ যোগ্যতায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতা করেই এ পর্যন্ত এসেছে। সেই মাপকাঠিতে তাদের নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।”
হোলি আর্টজান বেকারিতে হামলার পর অনেক বিদেশি কোম্পানির প্রধান বাংলাদেশি কোম্পানি ছেড়ে দেন।
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
আবার রাজনৈতিক কিছু চ্যালেঞ্জের কারণেও বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে নিয়োগ বেড়েছে বলে মনে করছেন পিডব্লিউসি’র ম্যানেজিং পার্টনার মামুন রশিদ।
সিটিব্যাংক এনএ, স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকসহ মোট চারটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে তার ৩০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা আছে।
তিনি জানান, যেসব বিদেশি কোম্পানির প্রধান হংকং, দুবাই, ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাজ করতেন। ঢাকায় হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর তারা বাংলাদেশ থেকে চলে যান।
এছাড়া কোভিড মহামারি চলাকালে আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের সিইও যারা বিদেশ থেকে এসে কাজ করতেন, যেমন: রোববারে এসে শুক্রবারে চলে যেতেন। তারা বিধিনিষেধের কারণে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় আর আসতে পারছেন না।
আবার যে সমস্ত বাংলাদেশি ইতিমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাজ করেছেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এখন তাদেরকে অফার দেয়া হচ্ছে নিজের দেশে কাজ করতে।
তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
সুইডেন ভিত্তিক পোশাকের ব্র্যান্ড এইচ এন্ড এমের রয়েছে বাংলাদেশে বিরাট কার্যক্রম।
মি. রশিদ বলেন, “ইদানীংকালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের প্রসার হয়েছে, বাজারের ব্যাপ্তি ঘটেছে। যেহেতু রিসোর্স আছে তাই বাংলাদেশে যে বিদেশিরা কাজ করতেন, তাদেরকে এখন রিপ্লেস করা হচ্ছে। এমনকি আমাদের গ্রাহকরা বাংলাদেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্নদের ওয়েলকাম করছে। কারণ বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বাংলা ভাষাভাষীদের সাথে কাজ করার সুফল বেশি।”
তার মতে, কাজটির চাহিদা, প্রত্যাশা, মানদণ্ড হিসেবে যদি কেউ যোগ্য বিবেচিত হন, তাহলে তাকে নিয়োগ দেয়া হবে, তা তিনি যে দেশের নাগরিক হোন না কেন।
বিষয় হল তিনি বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন প্রার্থী কিনা। তিনি আন্তর্জাতিক লক্ষ্য, ব্যবসার ভাষা, মান, রক্ষা করতে পারছেন কিনা।
মি. রশিদ আরও বলেন, “যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, কাজের পারফর্মেন্স এবং অর্জনের বিষয়গুলোই বিবেচনা করা হবে। এমন অনেকে আছেন যারা বিদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেও সফলতার সাথে কাজ করেছেন, দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।”
আবারে এই নতুন নেতারা তাদের নেতৃত্ব গুনে আরও নেতা তৈরি করছেন যেন বাংলাদেশিদের নেতৃত্বের পদ অব্যাহত থাকে বলে তিনি জানান।