রাজু আলাউদ্দিন
আমাদের লেখক-জীবনের শুরুতে মুর্তজা বশীর ছিলেন এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব: যে-মানুষ ছবি আঁকেন আবার লেখালেখিতেও দারুণ। ত্রসরেনু এই নামটিও মনের মধ্যে গেথে গিয়েছিল তখন থেকেই। সিনেমা, উপন্যাস, গল্প-এসব মাধ্যমে কোনো চিত্রশিল্পী কাজ করছেন এমন নজির দেশে বা বিদেশে খুবই কম আছে। তার সঙ্গে তুলনা দেয়া যেতে পারে স্বভাষায় সত্যজিৎ রায় কিংবা পূর্ণেন্দু পত্রীকে। বিদেশে জাঁ ককতো। ককতো মানেই রং ও বর্ণমালার এক বর্ণাঢ্য চরিত্র। মুর্তজা বশীরও ছিলেন আমাদের কাছে সেরকমই এক চরিত্র।
কবিতা তিনি খুব বেশি লেখেননি, এমনকি ধারাবাহিকও নয়, কিন্তু তার কবিতাগুলো খুবই আলাদা বৈশিষ্ট্যে দীপ্ত। ওগুলোতে আছে অভাবনীয় ইমেজ আর অদ্ভুত সব পারম্পর্যে বাঁধা। কখনো কখনো নারীদেহের কাক্সিক্ষত নগ্নতা এসেছে খোলামেলাভাবে।
ত্রসরেন নামের কবিতায় তিনি এক বান্ধবীর সাথে দেখা করার কথা জানাচ্ছেন। কবিতাটিতে আছে চোখ ধাঁধানো সব চিত্রকল্পের পাশাপাশি প্রায় পরাবাস্তৎ কিছু দৃশ্য:
সময়ের অনুপল
না জানি কত চৌকোন রঙিন পাথরকুচি বুকে
রাভেনায় সেন্ট ভিটায়েলে মোজাইকে ছবি হলো। নতরদামের
গীর্জাঘড়ি ঘোড়দৌড়ে বাজি হেরে আলস্যে ঝিমোয়;
অফুরন্ত অবকাশ তাই কোথাও কাটাবো ব’লে
স্বর্ণ দুপুরে পিগালে পর্ণো দোকানে
সুন্দরী বিদেশিনীর
নগ্নছবিতে উজ্জ্বলরস খুঁজি, কখনো বা বই নেড়েচেড়ে দেখি।
আমি নিশ্চিত, তিনি যদি শুধুই কবিতা লিখতেন তাহলে এদেশের শীর্ষ কবি হয়ে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু শুধুই কবি হওয়া তার একমাত্র নিয়তি ছিল না, গল্প, উপন্যাসও তাকে লিখতে হয়েছে। এমনকি, ইতিহাসে লুকিয়ে থাকা তথ্য ঘেঁটে তাকে উদ্ধার করতে হয়েছে মধ্যযুগের নানান মুদ্রার পরিচয় আর সেই পরিচয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট জাতিগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সবাই জানেন, ডাকটিকিট ও মুদ্রা সংগ্রহের ব্যাপারে তার ছিল প্রবল আগ্রহ। তার সঞ্চয় বিশাল। জানি না, ঢাকা শহরে অত বড় সংগ্রহ আর কারোর আছে কিনা। সম্ভবত মুদ্রা সংগ্রহের বিশাল ভা-ারই তাকে নিয়ে গেছে ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ নামক গ্রন্থ রচনায়।
অনেকেই হয়তো জানেন, ১৯৫২ সালে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘ পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের উপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তার কবিতা ছাপা হয়।
১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ুন কবীর রচিত ‘নদী ও নারী’র চিত্রনাট্যকার, শিল্পনির্দেশক এবং প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র শিল্পনির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এসব তথ্যও আমাদেরকে সেই কালে এই মানুষটি সম্পর্কে এক সম্ভ্রম তৈরিতে ভূমিকা পালন করেছিল। আরও কিছুকাল পরে শিশির দত্ত সম্পাদিত স্বনির্বাচিত সংকলনটি বের হলো সেখানে তার আঁকা ৪৮ জন কবির রেখাচিত্র দেখে তার প্রতি আরেকমাত্রায় আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্র থাকলেও ২০১০/১১ সালের আগে তাকে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আর তখন দেখলেও, তা ছিল দূর থেকে দেখা। তবে সেই দেখা পরে ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে ২০১৪ সালে যখন তার সাক্ষাৎকার নেয়ার জন্য তার বাসায় গিয়েছিলাম। নানা সময়ের ব্যবধানে আমি তার চারটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম যা পরে গ্রন্থাকারে বেরিয়েছে পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে। গ্রন্থাকারে বেরুবার আগে সেগুলো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর আর্টস বিভাগেও বেরিয়েছিল। আর প্রকাশমাত্রই সেগুলো পাঠকপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল খুব। বশীর ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎকারের সূত্রে যোগাযোগ হলেও তার সাথে আমার গভীর এক হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল। সেটার কারণ খানিকটা আমার শহীদুল্লাহ-প্রীতি আর খানিকটা চিত্রপ্রীতি। শহীদুল্লাহ যে এখনও বহু ক্ষেত্রে উন্মোচন ও মূল্যায়নের অপেক্ষায় এবং কারো কারো দ্বারা অবমূল্যায়িত – এসব ব্যাপারে আমাদের অবস্থানের ঐক্য হৃদ্যতাকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এই ব্যাপারটা ছাড়াও তিনি আমাকে অন্য কিছু কারণেও স্নেহ করতেন। তার স্নেহ অর্জন করা যে সহজ নয় তা বশীর ভাই-এর মেজাজ সম্পর্কে যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন। তিনি কখনো কখনো রূঢ় হয়ে উঠতে পারতেন যদি তা মেজাজের অনুকূল না হয়। আবার এই মানুষটিই রূঢ় আঘাতের পরেই শিশুর মতো সারল্যে বুকেও টেনে নিতে পারতেন। আমার সঙ্গে যদিও এমনটা কখনো ঘটেনি কিন্তু অন্যদের মুখে, অন্যদের অভিজ্ঞতা আমি শুনেছি।
এত সৎ, স্পষ্টভাষী, আদর্শনিষ্ট আর জ্ঞানদীপ্ত মানুষ আমি কমই দেখেছি। এত সব বিষয়ে তার উৎসাহ ও চর্চা ছিল যে তা রীতিমতো মুগ্ধ করার মতো। আমি তার শ্রোতা যেমন ছিলাম, তেমনি ছিলাম তার চিত্রকর্মের মুগ্ধ দর্শক। রেখাচিত্রে তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। অতি অল্প টানে আভাসিত করে তুলতে পারতেন যে-কোনো আদলকে এবং তা মাত্রই কয়েক মিনিটে। এই লেখাটি লেখার আগে আগে আমি তাকাচ্ছিলাম তার নিজের কিছু আত্মপ্রতিকৃতির দিকে। তিনি বেশ কিছু আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছিলেন যার একটির সঙ্গে আরেকটির মিল খুব একটা নেই, অথচ প্রত্যেকটিতেই তাকে চেনা যায় আবার প্রতিটিই কোথায়ও কোথায়ও আলাদা। আমি তার এই কাজগুলোর খুব তারিফ করেছিলাম। তিনি মিষ্টি হাসি দিয়ে সেই তারিফ গ্রহণ করলেও ওখানটায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। তিনি নতুন নতুন কাজের আইডিয়ার কথা বলতেন।
করোনাভাইরাস এসে আমাদের সরাসরি যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করেছিল বটে কিন্তু ফোনে যোগাযোগ ছিল প্রায় নিয়মিতই। কখনো কখনো যদি কাজের চাপে ভুলে যাওয়ার কারণে তাকে ফোন করতে দেরি হতো তখন তিনি ফোন করে খানিকটা অভিমানের সুরে অভিযোগ করতেন। আমি লজ্জিত হয়ে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, এবং তিনি ক্ষমা করেও দিতেন। প্রত্যেকবারই ফোন করলে আমার বউ আর মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করতেনই। মেয়ে ছবি আঁকে জেনে ওকে উৎসাহ দিতে বলতেন। আমরা একবার মেয়েকে কোনো একটা আর্টের স্কুলে ভর্তি করাবো শুনে উনি নিরুৎসাহিত করলেন। বললেন, শিশুদের একটা জগত আছে যা ব্যাকরণ দিয়ে চলে না। ওকে এই বয়সে ব্যাকরণ শেখাতে গেলে ওর ওই জগতটা নষ্ট হয়ে যাবে।
শেষবার অ্যাপোলোতে ভর্তি হওয়ার আগেও তিনি বেশ কয়েকবার এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। আমি প্রত্যেকবারই গিয়েছি। একবার আমি সস্ত্রীক গিয়েছিলাম। তিনি খুব খুশি হয়েছিলেন। হবারই কথা। হাসপাতালে কেউ আপনাকে দেখতে যাওয়া মানেই আপনি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর ওই একাকী নিঃসঙ্গ সময় কারোর উপস্থিতি রোগীর কাছে শুধু কাম্য নয়, রীতিমত আনন্দদায়ক। কিন্তু এবার, করোনাভাইরাস আমাদেরকে সেই সুযোগটি দেয়নি। তার চিরবিদায়ের আগে এক নজর দেখার বা তাকে শেষবারের মতো স্পর্শ করার সুযোগটাও দিল না। এই দুঃখ চিরটাকাল একটা ক্ষত হয়ে থেকে যাবে।
বশীর ভাই ছিলেন আমাদের এই দেশে জয়নুল-প্রতিষ্ঠিত চারুকলা ইনস্টিটিউট-এর দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনিই ছিলেন সর্বশেষ শিক্ষার্থী। আবার এই পরিচয়ের বাইরে তিনি যে বহুমুখিতা নিয়ে শিল্পচর্চা করেছেন – সেই দিকে তিনি ছিলেন মুষ্টিমেয়দের একজন এবং সর্বশেষ জনও। ফলে তার প্রয়াণে একটি যুগের অবসান হলো। তার প্রয়াণে গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
বিডি নিউজের সৌজন্যে