রতন কুমার তুরী »
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে প্রায় দশ হাজার বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবন। সুন্দরবনের বেশিরভাগ পড়েছে বাংলাদেশে। এটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন এবং বদ্বীপ। সুন্দরবনের কিছু অংশ ভারতীয় অঞ্চলে হলেও বাংলাদেশের খুলনা সাতক্ষীরা অঞ্চলজুড়েও রয়েছে এর বিশাল অবস্থান। এই প্রাকৃতিক বনটি বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত, এতে রয়েছে অসংখ্য বনজ গাছ-গাছালি, বন্যপ্রাণী, মাছ, কুমির ইত্যাদি। বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলে বাস করে বিশ্বের একমাত্র ডোরাকাটা বাঘ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্যও বিখ্যাত। সুন্দরবনের প্রায় এলাকাজুড়ে সুন্দরি গাছের ছড়াছড়ি। এগাছ বনটিতে প্রাকৃতিকভাবেই জন্মায় এবং প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে। এমন সুন্দরি গাছের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য সুন্দরবন ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও চোখে পড়ে না। সুন্দরবনে যত্রতত্র সুন্দরি গাছের জন্মানো এবং বেড়ে ওঠার কারণেই এই বনটির নাম রাখা হয়েছে সুন্দরবন।
সুন্দরবনের বুক চিরে অসংখ্য নদী এবং শাখা নদী প্রবাহিত হয়েছে সেসব নদীতে পাওয়া যায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ,কুমির, কাঁকড়া। সুন্দরবনের আশেপাশে অসংখ্য জেলে এসব নদী থেকে মাছ কাঁকড়া ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে যুগ যুগ ধরে । সুন্দরবনের ভেতরে রয়েছে ঘন গভীর বন, সুন্দরি, গেওয়া, শাল, গজারি, গর্জনের পাশাপাশি কিছু নাম নাজানা বৃক্ষ, অসংখ্য ঝোপ-ঝাড়। রয়েছে গোলপাতা। এসব গোলপাতা সংগ্রহ করতে অসংখ্য মানুষ প্রায় প্রতিদিন সুন্দরবনে প্রবেশ করে। গোলপাতা সুন্দরবনের আশে- পাশের মানুষেরা ঘরের ছাউনি হিসেবে ব্যবহার করার ফলে এটির বাণিজ্যিক মূল্য রয়েছে । এছাড়া সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য পশু-পাখি। এদের মধ্যে হরিণ, বনমোরগ, বানর, শুকর, সজারু, গুইসাপ ইত্যাদিই প্রধান। পাখিদের মধ্যে রাজ ধনেশ, পানকৌড়ি, বক, টিয়া, ময়না, বিভিন্ন রঙ্গের চড়ুইসহ আছে আরো কয়েকশ প্রজাতির পাখি। সুন্দরবন পশু-পাখিদের জন্য অভয়ারণ্যে পরিণত হওয়ায় এখানে এখনও বিরল কিছু পশু-পাখিদের আনাগোনাও দেখা যায়। সুন্দরবনের প্রধান আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। এই রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে অনেক সময় সুন্দরবনের বিভিন্ন খাঁড়িতে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সুন্দরবন এলাকায় বেশকিছু এলাকার রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা হয়েছে এসব এলাকায় বন প্রহরীর সহায়তা ছাড়া জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা আছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার এরিয়ায় রয়েছে বিপুল পরিমাণ হরিণ এবং বানরের আনাগোনা। হরিণ মূলত বাঘেদের প্রিয় খাবার। হরিণ ছাড়াও বাঘ, বানর, শুকর সহ আরো কিছু জীব-জন্তু ভক্ষণ করে থাকে।
একসময় সুন্দরবনজুড়ে ব্যাপক রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং হরিণ দেখা গেলেও বর্তমানে এই দুই প্রজাতির পশুই সুন্দরবনে কমে গেছে। চোরা শিকারিরা বাঘের চামড়া এবং হরিণের মাংস বিক্রি করার জন্য ব্যাপক হারে এদের নিধন করায় এদের সংখ্যা কমে গেছে। এখনও অবশ্য সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ বেশ কিছু রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সুন্দরবন বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ হওয়ায় এখানে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক আসে এখানে ঘুরে বেড়ানোর জন্য। এসব পর্যটকরা অনেকেই বনপ্রহরীর সহায়তায় সুন্দরবনের গভীরে পর্যন্ত যায় শুধুমাত্র একনজর রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার জন্য। সুন্দরবনে হরিণসহ অন্যান্য সব পশু-পাখিদের দেখা সহজ হলেও রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখা একটু কঠিন, এদের দেখতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। অনেক সময় অনেক দূর থেকেই এদের দেখে চলে আসতে হয়।
সুন্দরবন আমাদের যুগ যুগ ধরেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে আসছে। এর ঘন অরণ্য এবং বড় বড় গাছগাছালিসমূহ বাংলাদেশকে অনেক ঘূর্ণিঝড়, সাইক্লোন, বন্যা থেকে বাঁচিয়েছে। বিভিন্ন সময় আমরা বঙ্গোপসাগরের গভীরে উৎপন্ন ঘূর্ণিঝড়কে সুন্দরবন দিয়ে চলে যেতে দেখেছি এতে সুন্দরবন নিজে ক্ষত- বিক্ষত হলেও বাংলাদেশকে ঠিকই সুরক্ষিত রেখেছে। বিগত দশকে এধরণের অন্তত দশটা ঘূর্ণিঝড় থেকে বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছে সুন্দরবন।
সুন্দরবনকে সেই হিসেবে বাংলাদেশের জন্য একমাত্র প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল বলা যায়। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের এই প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল সুন্দরবনকে আরো বেশি করে যতœ নেওয়ার।
এটা অনভিপ্রেত যে, সুন্দরবনের কাছাকাছি শিল্পায়নের তোড়জোড় শুরু হয়েছে। পরিবেশবাদীরা তীব্র আপত্তি জানিয়ে আসছেন এই মর্মে যে, শিল্পায়নের ফলে সুন্দরবনের প্রাণীবৈচিত্র্য ধ্বংস হবে, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট বন, গাছ-গাছালি মরে যাবে। নদীগুলোর মৎস্য সম্পদের অবলুপ্তি ঘটবে। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং আমাদের প্রাকৃতিক বর্ম সুন্দরবনকে যে কোন মূল্যে অক্ষত রাখতে হবে, এর প্রকৃতি ও পরিবেশ বৈচিত্র অক্ষুণœ রাখতে সকল প্রয়াস নিতে হবে।
আমাদের প্রত্যকের উচিত সুন্দরবনের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তা দেখভাল করার। এ বিষয়ে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য সরকারকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনবোধে সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য জাতীয় কমিটি গঠন করে তাদের মাধ্যমে সুন্দরবন রক্ষার বিভিন্ন সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। বিশেষ করে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে যে সমস্ত বৃক্ষরাজি, পশুপাখি এবং জীবজন্তু রয়েছে তাদের সুরক্ষার জন্য সরকারকে সব রকমের ব্যবস্থা নিতে হবে। এর বাইরে সুন্দরবনের আশেপাশে যে সমস্ত জনবসতি রয়েছে তারা যাতে শুধুমাত্র সুন্দরবনের আহরণযোগ্য জিনিসপত্রই আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে এবং কোনো ধরনের পশুপাখি হত্যা না করে কিংবা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মত পশু শিকার করে চামড়া বিক্রি করতে না পারে সেসব বিষয়ের কঠোর নজরদারি করতে হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনবোধে কঠোর আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে সুন্দরবন বিভিন্ন দুর্যোগের সময় বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমাদের লাখো মানুষের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করে ফলে এই সুন্দরবনকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের সবারই কর্তব্য। তাই আসুন আমরা সবাই বাংলাদেশের একমাত্র প্রাকৃতিক সুরক্ষা দেয়াল সুন্দরবনকে রক্ষা করি এবং দেশের মানুষকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাঁচাই।
লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।