তসরিফা ইয়াছমিন :
শুকনো পাতার মতো টুপটুপ ঝরছে সময়ের এক-একটা পাতা। বুকের কাঁপনে খসে খসে পড়ছে হারানো কতো ছবি।
সুনসান জনহীন মক্তবের পথে ঝিরঝির কুয়াশার আলিঙ্গন।তখনও বাঁশঝাড়ের কুঠরিতে আটকে থাকে রাতের ধূসর আঁধার। নিস্তব্ধতার জঠরে হঠাৎ পাখিদের গুঞ্জরণ। বুকে কায়েদা, আমপারা আর মাদুর জড়িয়ে ছুটতে ছুটতে আমাদের প্রভাত শুরু হতো। হুজুরের মায়াবী চিকন সুরের সবক নিয়ে সুর করে দুলে দুলে সবাই পড়তাম। কনকনে শীতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের সুরলহরিতে মক্তবপাড়া মুখর হয়ে উঠত। তাদের কেউ এখন প্রকৌশলী, কেউ ব্যাংক কর্মকর্তা, কেউ শিক্ষক কেউবা ব্যবসায়ী, আবার কেউ দারিদ্র্যের ঘানিতে থেঁতলে গিয়ে অকালবার্ধক্যে ঝিমিয়ে পড়া মানুষ।
মক্তবের পথখানা ধীরে ধীরে সোনারোদ গহনায় সেজে উঠলে মাচাভর্তি কুমড়োর ফুলগুলো স্নান সেরে রোদে গা শুকাতে বসলে আর ঘাসের পাড়ায় তারাফুল ও শিশিরের মুকুটে ঝলমল করলে আমাদের ছুটি হতো।
দিগন্তব্যাপ্ত ধানখেতের সরু আলপথ দিয়ে নুরু কাক্কু খেজুর রস নামাতে আসত খুব ভোরে। কুয়াশার আঁধারের সাদা পাতলা চাদরে ঢাকা চিরচেনা পথ ধরে। তরতর করে উঠে যেত লম্বা, ভেজা পিছল গাছে। খেজুর কাঁটার শাখাতলে যুগ যুগ ধরে দারুণ দক্ষতায়, সৌকর্যে তার এ কাজ চলত।
লজ্জাবনত ভোরের সূর্য আলপথে ঘোমটা খুললে, চারুবুড়ি বিশাল মুড়ি-মোয়ার ঝাঁকা মাথায় নিয়ে ধীরে ধীরে তার পথচলা শুরু করত। পরনে সাদা পুরোনো ময়লা থান। গলায় গেরুয়া মালা। গায়ে ছেঁড়া শাল। হিন্দুপাড়ার হতদরিদ্র বিধবা বৃদ্ধা। চোখজোড় ছিল মরামাছের চোখের মতো স্থির আর বিধ্বস্ত। তার চোখের হতাশা ও বেদনার ভাষা সেদিনকার ছোট্ট বালিকার কাছে বড়ই দুর্বোধ্য ছিল। আমাদের উঠানে মুড়ি-মোয়ার ঝাঁকা রেখে বিচালিতে বসতেই আমরা তাকে ঘিরে ধরতাম। তারপর চমনবাহার জরদার সুবাস কাঁপিয়ে দাদি আসতেন। টকটকে পানের রসে অধর ভিজিয়ে রানির মতো মোড়ায় আসন গ্রহণ করতেন। দাদি মুড়ি কিনতেন। একপট ধানে একপট মুড়ি।
সেসব আজ পুরোনো জরাজীর্ণ বাক্সের তলায় পড়ে থাকা তালপাতার পুঁথির কাহিনি যেন। ধুলোমলিন সে ছবিগুলো আজ বড় আদরের। বুকের ভেতরটা কাঁপিয়ে-নাড়িয়ে, ভাসতে ভাসতে রঙিন হয় উঠল যেন।
পৌষের সেদিনগুলো খুঁজতে আমি ছুটলাম। কোথাও কিছু নেই। নুরু কাক্কু নেই, খেজুরের সেই রস নেই। চারুবুড়ি আসার সে আলপথ এখন প্রশস্ত, পরিপাটি। মাথায় ঝাঁকা নিয়ে সে পথে কাউকেই দেখলাম না। আগুন পোহানোর উৎসবের আয়োজন নেই। বিলের মাঝখানে কচুরিপানার বেগুনি ফুলভর্তি আদুম্মা পুকুর এখন স্বচ্ছ অতলজলে টলমল করছে। তার চারপাশের নারকেলবনে এখন সুবেশী বাতাসের আলাপন।
পূর্বপাড়ায় কোথাও একচিলতে মাটির ঘর চোখে পড়ল না। সব দালান। ভিটেয় লাগানো যে শস্যখেত এ সময় রবিশস্যে সবুজ হয়ে উঠত, তার বেশির ভাগ এখন পড়ে আছে ঊষরের মতো।
নৈঃশব্দ্যের আঁধার ছাপিয়ে ঊষাকালে ডাহুকের জলকেলির গল্প, অদূরের কোনো আঙিনায় ঘন কুয়াশার ফাঁকে দাউ দাউ আগুন শিখার নাচন, চারুবুড়ির মুড়ির ঝাঁকা, নুরু কাক্কুর খেজুর গাছকাটার টকটক শব্দ- সেসব পৌষের দিনগুলো আমি অধীর হয়ে খুঁজতে লাগলাম। সবকিছু যেন ঐ শস্যহীন ঊষর মাঠের মতো নির্জীব, মুখ থুবড়ে পড়ে আছে।
ডানা ভাঙা পাখির মতো চলছে সব পায়ে পায়ে। এসবে ওই সুললিত ছন্দ কই! আহা! আমাদের পৌষের দিনগুলো। আজ যেন সব অন্যপৃথিবীর গল্প।