আরিফুল হাসা :
তখন কাঠুরে দ্বিতীয়বার তার গল্পটি বললো। লোকেরা এবারও স্তব্ধ হয়ে শুনলো। যতক্ষণ কাঠুরে তার গল্প বলে যাচ্ছিল ততক্ষণ কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। এবার গল্পবলা শেষ হলে আবারও পূর্বের মতো কানাঘুষা শুরু হলো। এ-ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে, এ-ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। তরুণছেলেরা অধৈর্য হয়ে উঠে যেতে চায়। মুরুব্বিরা তাদের প্রতিহত করে। তারপর কাঠুরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, আবার কও তো বাপু। এহনো তোমার কতা ঠিক বুইঝা উঠতাম পারতাছি না! কাঠুরে তৃতীয়বারের মতো তার গল্পটি বলা শুরু করে।
‘আমি গেছিলাম কাট কাটতাম। ডেলি যেমুন যাই। গেলাম নদীর পাড়ে দিয়া দুরুইত থাইক্কা দ্রুুই। অই যে মোবার বাড়ি আছে না? তারও আরও পরে। পচিম ফাইল আটতাছি তো আটতাছি। এরপর আইলো ঘনজঙ্গল, টিয়ারার জঙ্গল; হেই জঙ্গলে আমি পতিদিন কাট কাটতাম যাই। বেইন্না বেইন্না কাট কাইট্টা বাজরো নিতে পাল্লে দুই-চাইর পইসা পাই। কিন্তু কি দুর্গুতি, আইজগা কুনু কাট কাটতাম পারলাম না।’
‘কে রে? কে রে তুমি কাট কাটতা পারছ না?’ অধৈর্য হয়ে ওঠে করিম শেখ। কাঠুরে আবার বলতে শুরু করেÑ জঙ্গলে গিয়া একটা একটা মোডা গাছো কুড়াল মারি। কুরাল ফিরা আইয়ে। একবিন্দু গাছের ছাল কাডে না। আবার মারি, আবার মারি, বারে বারে মারি। কিন্তু এহই অবস্তা। গাছ কাডে না। নিরাশ অইয়া গাছের গোরাত বই। হেইখানে আমার ঘুম আইয়া পড়ে।
ঘুমের মইধ্যে স্বপ্ন দেহি হেই গাছ কুনু গাছ না। আসলে অইডা একটা মানুষ। এরপরে ডরে আমার ঘুম ভাইঙ্গা যায়। আমি দউইরা গেলাম নদীর কাছে। পারো বইয়া কুশ কইরা পানি তুলতে গেলাম, পানি আমারে দেইখ্যা নিচের ফাইল নামন শুরু করছে। আমিও পানির লাইগ্যা বেজান অইয়া পিছে পিছে যাওন শুরু করলাম। পানি নামতে নামতে নদীর তলাত চইল্লা গেলো। আৎকা দেখলাম, পাওর নিচের বালুতে আমি ডুইব্বা যাইতাছি গা। কিন্তু এতক্কনে আমার আর কুছু করার আছিলো না। আমি বালুর তলে পুরাপুরি ডুইব্বা গেলাম।
এরপরে, এরপরে? দু’চারজনের উত্তেজিত গলা শোনা যায়। কাঠুরে আবার তার গল্প বলতে থাকে। বলতে থাকে কী করে সে নদীতলদেশের বালিয়াড়ির ভেতর ডুবে গেল এবং যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন সে কী কী দেখতে পেল। এবং সে বর্ণনা করে, তার সাথে কী কী ঘটেছিল সেই পাতালরাজ্যে। সে বলতে থাকেÑ ‘আমি দেহি, ঝকঝইকা একটা রাজবাড়ি। আমি উদাম গতরে কান্ধো কুড়াল ঝুলাইয়া বাগানের মইধ্যে একলা খেরা অইয়া রইছি। কুনফাইল যামু বুঝতাম পারতাছি না। কেওইরে দেখতামও পাইতাছি না। এমনে থুরাক্কন না খেরইয়া থাহার পরে একটা ছুডু মাইয়া আইয়া আমার আত ধইরা রাজবাড়ির ভিত্রে লইয়া গেল।
রাজবাড়ির ভিত্রে গিয়া আমার আবার বেয়ুশ অওয়ার মতো অবস্তা। দেকলাম, দামি দামি মণিমুক্তা, হিরা-চুন্নি চাইরোফাইল টাল টাল কইরা থুইয়া রাকছে। ওইডির রোশনাইয়ে আমার চউখ আন্ধাইর দেহন আরম্ভ করছে। আমি মাতা ঘুরাইয়া পইরা গেলাম। ইট্টু পর দেহি, ওই বাচ্চা মাইয়াডা আমারে পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতাছে। আমি কইলাম, ‘আমি কই?’
বাচ্চাডা কইল, ‘পাতাল রাইজ্যত আছ।’
গ্রামের লোকজন অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কাঠুরের ঠোঁটনড়া একটু বন্ধ হলেই আবার তাড়া দেয়। এই নিয়ে তৃতীয়বার তারা গল্পটি শুনছে। প্রথম যখন শুনে তখন কেউ কোনো কথা বলেনি। একদম মধুপোকের মতো ঝুপ্ মেরে বসে ছিল। দ্বিতীয়বারের বেলায়ও তারা কোনো কথা বলেনি। একদম ঝিম মেরে আপাদমস্তক গল্পটি শুনেছে। কিন্তু কেন যেন তাদের মনের খটকাটা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এমন গল্প বারবার শোনা যায়। তাই তারা তৃতীয়বারের মতো কাঠুরের কাছে গল্প শুনতে বসে এবং এবার ফাঁকে ফাঁকে এক-দু-জন প্রশ্ন করে কাঠুরের গল্প বলার উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে। অথবা তারা নিজেরাই শ্রবণ-উত্তেজনা বিরাম করতে না পেরের কাঠুরেকে প্রশ্ন করে। কাঠুরে মাটির কলস থেকে সিলভারের মগে জলভরে খায়। একপাশে টেপ খাওয়া মগটির পুরোটা জল একনিশ্বাসে শেষ করে আবার বলতে শুরু করে,
আমি কইলাম, আমি এট্টু পানি খাইয়াম। বাচ্চডা আমার মুখের ফাইল তাজ্জব অইয়া চাইয়া থাকলো কত্কন্। এরপরের কইলো, পানি নাই। আমার বুক তহন হুগাইয়া কাট অইয়া গেছে। আমি কইলাম, পানি না পাইলে বাচতাম না। হে আমারে কইলো, এহানে নাকি সব পাওন যায়, খালি পানি ছাড়া। আমি বুকের তিরাসে আর বইয়া থাকতে পারলাম না। হুইয়া গড়াগড়ি করতে লাগলাম। হেয় আমারে কইলো, এইহানের সব মণিমুক্তা নিয়া যান, যত খুশি নিতে পারেন। কিন্তু পানি দেওন সম্ভব অইতো না। আমি বুক চাইপ্পা ধইরা কইলাম, আমার কুনু কিছু চাই না, শুধু পানি খাইতে চাই। বচ্চাডা তহন দউইরা বাইরে গেল। ঘীতকুমারির মতো কী একটা পাতা আমার মুহে দিয়া কইল, চাবান। আমি পাতা চাবাইতেই কুইয়রের মতো মিডা রসে আমার মুখ ভইরা গেল। আমি ঢোক গিল্লা প্রাণ বাচাইলাম।
এরপরে, এরপরে কী অইলো, Ñ তরুণ মোসাদ্দেক চেঁচিয়ে ওঠে। কাঠুরে আর গল্পটা আগায় না। চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বৃদ্ধ করিম শেখ আবার বলে, কও বাবা, কও। কাঠুরে তখনও বলতে পারে না। সে মাটির ভেতর কি যেন এক নকশা দেখতে থাকে। সবাই বলে, ঘোরে পড়ছে। কিন্তু যুবকেরা তা মানতে নারাজ।
অরে কইতেই অইবো।
দু-চারজন রক্তগরম যুবা দাঁড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এতে ভাবান্তর হয় না কাঠুরের। সে মাটির দিকে চেয়ে চোখের রশ্মি দিয়ে কি যেন ছক কাটতে থাকে। মুরুব্বিরা আবার থামায় যুবকদের। একজন মুরুব্বি তার আসন থেকে ওঠে এসে কাঠুরের মাথায় হাত রাখে, বাবা, কও, কও তোমার গল্পডা।
কাঠুরে এবার বলা শুরু করে,
অই জলপাতার রস খাওনের পরে আমার তিরাস মিডে। আমি কিছুডা ধাতস্ত অই। এরপরে বাচ্চাডারে জিগাই, এইহানে কি আর কেউ থাহে না? বাচ্চাডা আমারে কইলো, না, কেউ থাহে না। আমি শুধু একলা থাহি। আমি ডরাইয়া গেলাম। কইলাম, তোমার বাবা-মা কই? বাচ্চাডা কইলো, তারা মইরা গেছে। তারপর হে আমারে আত ধইরা টানতে টানতে বাগানে নিয়া গেল। একজোড়া গাছ দেহাইয়া কইলো, অই অইলো আমার বাবা-মা। আমি তাজ্জব অইয়া কইলাম, তোমার বাবা-মা গাছ অইয়া গেছে? বাচ্চাডা কইলো, হ, মানুষ মরলে তো গাছই অইয়া যায়। আমি হাসুম না কান্দুম বুঝতাছি না। বাচ্চাডা মনে অয় অনেক কিছু জানে। আৎকা আমার মনে পল্লো বনের মইধ্যে গাছের গোরাত ঘুমানের বেলা খোয়াবের কতা। আমি বাচ্চাডারে সবকিছু খুইল্যা কইলাম। বাচ্চাডা কইলো, হ, ঠিকই হুনছেন। আর এই কারণেই আপ্নেরে পাতাল রাইজ্যে টাইন্যা আনা হইছে যাতে আপ্নে আসল সত্যডা বুঝতেন পারেন। অই গাছটা, একটু দুম নেয় বাচ্চাডা; তারপর বলে, অই গাছটা অইলো করিম শেখের দাদার। বন্যার সময় কবর দেওনের জাগা না পাইয়া লাশ ভাওয়াই দেওন অইছিলো। ভাইতে ভাইতে লাশ টিয়ারার জঙ্গলে আইয়া আটকায়। হেইখানেই করিম শেখের দাদা গাছ অইয়া জন্ম নেয়।
সবাই তাজ্জব হয়ে শুনতে থাকে কাঠুরের গল্প। করিম শেখ বৃদ্ধ মানুষ। তার দাদা মারা গেছে প্রায় চল্লিশ বছর আগে। করিম শেখের মনে আছে, সে বছর ভয়ানক বন্যায় সবাই মাচার ওপর জীবনযাপন করছিল। চলতে-ফিরতে না পারা বুড়োটা রাতে কখন যে মাচা থেকে পড়ে যায়, কেউ টের পায় না। দিনের বেলায় কচুরির ঝোপে তার লাশ ফুলে ভেসে ওঠে। সেই অবস্থা থেকেই সবাই লাশটাকে কোনোরকম ধোয়ায়ে মার্কিন কাপড়ের কাফন পরিয়ে নৌকায় দাঁড়িয়ে জানাজা শেষে কলার ভেলায় করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। করিম শেখের চোখ ভিজে আসে। সে কাঠুরের কাঁধে আলতো হাত রেখে হু হু করে কেঁদে ওঠে। কিন্তু করিম শেখের ছোট ছেলে মোসাদ্দেকের চোখে তখন অন্য এক পরিকল্পনা বিরাজ করছে। সে কাঠুরের মুখে পাতালরাজ্যের মণিমাণিক্যের গল্প শুনে ভেতরে ভেতরে খুব লোভী হয়ে ওঠে। এবং কাঠুরের বর্ণনা মতো সেও সেই পাতালরাজ্যে পৌঁছাতে চায়। সে মনে করে কাঠুরের মতো একই প্রক্রিয়ায় এগুলো হয়তো সেও পৌঁছতে পারবে পাতালরাজ্যের মণিমাণিক্যের কাছে। ভাবনা মতো সে সন্ধ্যা নামলে একটি কুঠার হাতে চুপি চুপি টিয়ারার জঙ্গলে গিয়ে পৌঁছায়। কাঠুরের বর্ণনা মতো খুঁজে খুঁজে বড় গাছটি বের করে। তারপর হাতের চকচকে কুঠারটি দিয়ে প্রবলবেগে কোপ মারে গাছের গুঁড়িতে। তাকে অবাক করে দিয়ে কুঠারটি গাছের গায়ে ইঞ্চি-দেড়েক গেঁথে যায়।