নিজস্ব প্রতিনিধি, চকরিয়া »
সোমবার থেকে শুরু হওয়া টানা চারদিনের ভারীবর্ষণে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভয়াবহ বন্যায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা। এতে উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন এবং চকরিয়া পৌরসভার লোকালয় বানের পানিতে ভাসছে। এই অবস্থায় উপজেলার ১৬১টির মধ্যে ১০৫টি গ্রামের অন্তত চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। টিউবওয়েল ও বসতবাড়ির রান্নার চুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকট পড়েছে পরিবারগুলোতে। অনেক স্থানে বাড়ির চালা পর্যন্ত পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে মানুষ।
এদিকে মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানির প্রবল তোড়ে কয়েকটি স্থানে ভেঙে গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধও। এতে চকরিয়ার উপকূলীয় মাতামুহুরী সাংগঠনিক উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে নতুন করে ঢুকে পড়ছে বানের পানি। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ পাহাড় ধসের শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে মানুষের মাঝে।
জেলা প্রশাসন থেকে চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৭২ টন জিআর চাল। এদিকে দুর্গত এলাকার পানিবন্দি পরিবারের জন্য লঙ্গরখানা চালু করেছেন জনপ্রতিনিধিরা। তার মধ্যে চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম ৫ হাজার, চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী ৩ হাজার, চকরিয়া উপজেলা চকরিয়া পৌরসভার আলমগীর চৌধুরী ৭ হাজার পরিবারের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছেন।
পাশাপাশি সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হকসহ জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে প্রতিটি ইউনিয়নে বন্যাকবলিত মানুষের ঘরে শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ।
বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা গেছে, উপজেলা সদরের সাথে ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম সড়কগুলো কয়েকফুট পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এতে সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। জরুরি প্রয়োজনে মানুষ নৌকায় চেপে যাতায়াত করছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানি চারদিন ধরে বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলার ফসলী জমিও বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকস্থানে ভেসে গেছে পুকুরের মাছও।
উপজেলার কাকারা, সুরাজপুর-মানিকপুর, বমুবিলছড়ি, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বিএমচর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী এবং চকরিয়া পৌরসভার বেশিরভাগ গ্রাম কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
চকরিয়া পৌরসভার মেয়র মো.আলমগীর চৌধুরী বলেন, টানা বৃষ্টিতে পৌরসভার নীচু এলাকার ১৫/২০টি গ্রাম ও তিনশতাধিক পরিবার জলাবদ্ধতার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের তোড়ে চকরিয়া পৌরশহর বাঁধসহ পৌরসভার চারপাশের বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
চিরিংগা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, ভারী বর্ষণ আর পাহাড়ি ঢলে ইতোমধ্যে আমার ইউনিয়নের বেশিরভাগ গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। তার মধ্যে সওদাগরঘোনা, বুড়িপুুকুর, চরনদীপ, রাবার ড্যাম এলাকার গ্রামগুলো নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের মধ্যে।
বরইতলী ইউপি চেয়ারম্যান জালাল সিকদার বলেন, ভারী বর্ষণে আমাদের এলাকার বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। অভ্যন্তরীণ বেশকিছু গ্রামীণ সড়ক পানিতে ডুবে রয়েছে। বুধবার সকাল থেকে ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
বিএমচর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভারিবর্ষণে ও মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি বেড়েছে। বুধবার সকালে ইউনিয়নের কইন্যারকুম অংশের ৩০ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় ডুবে যাচ্ছে উপকূলীয় লোকালয়। এতে ব্যাপক ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন উপকূলীয় সাত ইউনিয়নের মানুষ।
সুরাজপুর-মানিকপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম বলেন, আমার ইউনিয়ন একেবারে মাতামুহুরী নদী লাগোয়া। নদীতে পানি বাড়তে থাকায় এলাকার রাস্তাঘাট, ঘরবাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে।
পশ্চিম বড় ভেওলা ইউপি চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বাবলা বলেন, ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে ইউনিয়নের বেশিরভাগ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। ইউনিয়নের প্রায় পাঁচ শতাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামী বলেন, ‘প্রবল বর্ষণ ও মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানির তোড়ে চকরিয়ার বিএমচর ইউনিয়নের কন্যারকুম এলাকায় পাউবোর প্রায় ৩০ ফুট এবং কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনা পয়েন্টে ভেঙে গেছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ শামসুল তাবরীজ বলেন, ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকা এবং মাতামুহুরী নদীতে নেমে আসা উজানের পানিতে উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে। গতকাল পর্যন্ত উপজেলার ১৬১টির মধ্যে ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত চার লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে মানুষ চলে যায় সেজন্য মাইকিং করা হচ্ছে। পাহাড় ধসের আশঙ্কা থাকায় জনগণকে সচেতন করা হচ্ছে। পাশাপাশি উপকূলীয় এলাকার সøুইস গেইটগুলোর কপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। যাতে পানি ভাটির দিকে দ্রুত নেমে যেতে পারে।
ইউএনও বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিটিতে চার টন করে ১৮টি ইউনিয়নে ৭২টন এবং চকরিয়া পৌরসভার জন্য ১০ টন জিআর চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গতকাল উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রতিটি ইউনিয়নে বানবাসি লোকজনের মাঝে শুকনা চিড়া, খেজুর, এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ গুড় বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হয়েছে।