সুপ্রভাত ডেস্ক »
চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা থামছে না। প্রভাবশালীদের লোভের শিকার হয়ে একে একে পাহাড় যেমন নিশ্চিহ্ন হচ্ছে, তেমনি ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম মহানগর এবং আশপাশের এলাকায় পাহাড় ধসে ২৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পাশাপাশি আহতও হয়েছেন অনেকে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এত হতাহতের পরও বন্ধ হচ্ছে না চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন ও বসবাস। উল্টো পাহাড় কাটা ও অবৈধ দখলদারদের সংখ্যা প্রতি বছরই বাড়ছে। পাহাড় কাটার অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে নগরীর বিভিন্ন থানায় ২০২২ সালেও ২০টি এবং ২০২১ সালে ছয়টি মামলা দায়ের করেছে পরিবেশ অধিদফতর।
সবশেষ গত শুক্রবার বিকাল পৌনে ৬টায় নগরীর আকবরশাহ থানাধীন বেলতলীঘোনা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যান মো. মজিবুর রহমান খোকা (৪৫) নামে এক শ্রমিক। ওই এলাকায় সড়ক নির্মাণে ব্যাপকহারে পাহাড় কাটার সময় এ ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও তিনজন আহত হন। খবর বাংলাট্রিবিউনের।
চট্টগ্রামে বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে প্রতিবছরই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৭ সালের ১১ জুন। ওই বছর ২৪ ঘণ্টায় ৪২৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। ওই বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সেনানিবাস এলাকা, লেডিস ক্লাব, শহরের কুসুমবাগ, কাছিয়াঘোনা, ওয়ার্কশপঘোনা, মতিঝরনা, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ প্রায় সাতটি এলাকায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। ওই দিন ভোরে অল্প সময়ের ব্যবধানে এসব পাহাড় ধসে নারী-শিশুসহ ১২৭ জনের মৃত্যু হয়।
২০২২ সালে ১৭ জুন পাহাড়ধসে নিহত হয় আরও চার জন। ওই দিন রাত ২টায় এবং ১৮ জুন ভোর ৪টায় নগরীর আকবর শাহ থানাধীন ১ নম্বর ঝিল ও ফয়’স লেক সিটি আবাসিক এলাকায় এ পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আরও পাঁচ জন আহত হন।
২০০৮ সালের ১৮ আগস্ট চট্টগ্রামের লালখানবাজার মতিঝরনা এলাকায় পাহাড় ধসে চার পরিবারের ১২ জনের মৃত্যু হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই চট্টগ্রামের টাইগারপাস এলাকার বাটালি হিল পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৭ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ জুন পাহাড়ধসে চট্টগ্রামে ২৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে মতিঝরনায় দেয়াল ধসে দুই জন মারা যান। ২০১৫ সালের ১৮ জুলাই বায়েজিদ এলাকার আমিন কলোনিতে পাহাড় ধসে মারা যান তিন জন, একই বছরের ২১ সেপ্টেম্বর বায়েজিদ থানার মাঝিরঘোনা এলাকায় মারা যান মা-মেয়ে।
২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন ফিরোজশাহ কলোনিতে পাহাড়ধসে মারা যান চার জন। ২০১৯ সালে কুসুমবাগ আবাসিক এলাকা পাহাড়ধসে এক শিশু প্রাণ হারায়।
পাহাড় ধসে এত প্রাণহানির পরও বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা, দখল ও বসতি স্থাপনা। ২০০৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত পাহাড়ধস এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে আরও ১২১ জনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। সবমিলে ২০০৭ সাল থেকে গত ১৬ বছরে নগরে ও আশপাশে পাহাড়ধসে ২৪৮ জন প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
চট্টগ্রামে পাহাড় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত উপকমিটির তথ্যমতে, নগরের ২৫টি পাহাড়ে ১ হাজারেরও বেশি পরিবার ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে।
জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সর্বশেষ তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরীতে ২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় আছে। এর মধ্যে ১৭টি অতিঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে ৮৩৫ পরিবার বসবাস করে। ১৭ পাহাড়ের মধ্যে ব্যক্তি মালিকানাধীন ১০ পাহাড়ে অবৈধভাবে বাস করছে ৫৩১ পরিবার। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মালিকানাধীন সাত পাহাড়ে বাস করছে ৩০৪ পরিবার। এর মধ্যে বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড নির্মাণের সময় নতুন করে ১৬টি পাহাড় কাটা হয়। সেসব পাহাড়ে নতুন করে বসতি গড়ে উঠেছে।
এদিকে, গত ৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের সম্মেলন কক্ষে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির ২৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সাতটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। যার মধ্যে রয়েছে- সকল সংস্থা কর্তৃক পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের হালনাগাদ তালিকা প্রদান সাপেক্ষে জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযান; আগামী সভা থেকে সংস্থার প্রধান বা উপযুক্ত প্রতিনিধি সভায় উপস্থিত থাকবেন; পাহাড়ে অবৈধ বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে; পাহাড় কাটা বন্ধ করতে হবে; যাদের উচ্ছেদ করা হবে তাদের আশ্রয়ণে পুনর্বাসন বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে হবে; পাহাড় কাটা বা পাহাড়ে বসবাসের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং ৩৬ দফা সুপারিশমালা পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করতে হবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদের বিষয়ে সারা বছরই অভিযান চালানো হয়। আকবরশাহ এলাকায় ধসের স্থানে গত ১১ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালানো হয়। এ সময় এক ব্যক্তিকে সাত দিনের কারাদ- দেওয়া হয় এবং পাহাড় কাটায় ব্যবহৃত একটি এস্কেভেটর জব্দ করা হয়। এরপরও পাহাড় কাটা থেকে জড়িতদের সরানো যায়নি। গত সপ্তাহে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। পাহাড় কাটা বন্ধের পাশাপাশি ঝুঁকিপূর্ণ বসতিদের উচ্ছেদের অভিযান জোরদার করা হবে।’
চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদফতরের চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, ‘পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়া গেলেই অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হচ্ছে অথবা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ২০২২ সালে পাহাড় কাটার অভিযোগে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ২০টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ২০২১ সালেও ছয়টি মামলা করা হয়েছে।’