ফারুক হোসেন সজীব »
অপরূপ সুন্দর একটি গ্রাম ছিল। সেই গ্রামে একটি নদী ছিল। নদীটি এঁকেবেঁকে বয়ে যেত দূর-বহুদূরে। সেই নদীর জল ছিল ভীষণ স্বচ্ছ এবং পরিষ্কার। যখনি সূর্যের আলো নদীর জলে এসে পড়ত, ভীষণ চকচক করত। সেই নদীর জল পশু, পাখি, গ্রামবাসীরা সবাই ব্যবহার করত। নদীর পাশেই ছিল, একটি ফলদ বৃক্ষ। বৃক্ষটিতে প্রতি মৌসুমেই প্রচুর রসালো ফল ধরত। ফলগুলো ছিল ভীষণ মিষ্টি। মানুষ এবং পাখিরা সবাই সেই ফল খেত। বৃক্ষটি পরিবেশকে সতেজ রাখত। ছায়া এবং প্রশান্তি দিত। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল।
হঠাৎ একদিন ঘটল এক বিপত্তি! নদী এবং বৃক্ষের মাঝে তুমুল ঝগড়া শুরু হলো।
নদী বলল, আমি সবচেয়ে বেশি উপকারী। আমি মানুষ, পশু-পাখি, প্রাণী সবাইকে জল দিই। জল ছাড়া কি কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে? সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল!
বৃক্ষ উত্তেজিত হয়ে বলল, তুমি শুধু জল দিয়ে থাক, কিন্তু আমি দিই অক্সিজেন! যদি অক্সিজেন না দিতাম তবে, মানুষ, পশুপাখি, প্রাণীরা এক মিনিটও বাঁচতে পারত না! আমি তাদের শ্বাস নেওয়ার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস তৈরি করি। সবার প্রাণ বাঁচাই!
নদী বলল, হ্যাঁ, তা ঠিক, তুমি অক্সিজেন দাও। কিন্তু আমি নদী অর্থাৎ জল। জল ছাড়া তুমি তো কিছুই করতে পারবে না! তোমার শিকড় তো আমার জল শোষণ করেই তোমাকে বাঁচিয়ে রাখে। জল ছাড়া তুমি কীভাবে বাঁচবে?
বৃক্ষটি বলল, হ্যাঁ, এটা তুমি ঠিক-ই বলেছ। কিন্তু, তুমি কি কখনও ভেবে দেখেছ? যদি তোমার দুই পাশে বৃক্ষ না থাকত, তবে তোমার সৌন্দর্য কোথায় হারিয়ে যেত। আমরা বৃক্ষরা না থাকলে, তোমার জলও এমন শীতল হতো না! শুধু কি তাই! তোমাকে কেউ ভালোবাসত না। এমনকি কবিরাও তোমাকে নিয়ে কবিতা লিখত না!
নদী একটু থেমে বলল, তবে তুমি যাই বলো, জল ছাড়া কোনো প্রাণীই বাঁচে না। জল-ই জীবন!
বৃক্ষ বলল, তুমি ঠিক বলেছ! জল-ই জীবন। তবে আমি কিন্তু অক্সিজেন! আর অক্সিজেন ছাড়া কেউ বাঁচতে পারে না! তাই অক্সিজেন-ই জীবন!
এতক্ষণ বৃক্ষের ডালে বসে একটি ছোট্ট পাখি তাদের যুক্তি তর্ক শুনছিল।
হঠাৎ পাখিটি বলল উঠল, তোমাদের দুজনের যুক্তিই শুনেছি আমি! অসাধারণ অকাট্য য্ুিক্ত তোমাদের। আসলে তোমরা দুজনই জীবনের জন্য প্রয়োজনীয়। তাই তোমাদের অবদানও সমান।
বৃক্ষটি বলল, কী আমরা সমান! কীভাবে? বৃক্ষ এবং নদী দুজনই আপত্তি জানাল।
পাখি হেসে বলল, জল আর জীবন তো একই উৎসের দুটি রূপ। আমরা সবাই তো একই উৎস থেকেই এসেছি। শুধু ভিন্ন ভিন্ন রূপে। আসলে বৃক্ষ, নদী, প্রাণী মূলত একই!
আবার সৃষ্টিতত্ত্বের দিকে যদি তাকাও, তবে দেখতে পাবে, জল একটি ক্ষুদ্র অণু হলেও কিন্তু তিনটি পরমাণু নিয়ে গঠিত। দুটি হাইড্রোজেন এবং একটি অক্সিজেন!
বৃক্ষ অবাক হয়ে বলল, কী অক্রিজেন? আমাকে নিয়ে জল গঠিত? বৃক্ষ অবাক হয়ে হো-হো করে হাসতে লাগল। নদী ও অবাক হয়ে বলল, তার মানে আমরা একই উৎস থেকে সৃষ্টি?
পাখিটি বলল, হ্যাঁ, আমরা একই উৎস থেকে সৃষ্টি। শুনে বৃক্ষ বলল, তাহলে তো আমাদের মধ্যে তর্ক করা মোটেই উচিত নয়। বৃক্ষটি সাথে সাথেই বলল, তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও. নদী ভাই! নদীও বলল, তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দাও হে, পরম বৃক্ষ!
পাখিটি বলল, কিন্তু একটি দুঃখের বিষয় আছে!
বৃক্ষ, নদী অবাক হয়ে পাখিকে বলল, দুঃখের বিষয়! কী দুঃখের বিষয়?
পাখিটি বলল, প্রাণীদের মধ্যে এই সৃষ্টিতত্ত্ব সবাই বুঝতে পারলেও কেবল কিছু মানুষ আজও বুঝতে পারেনি যে, সমস্ত মানুষ মূলত একই উৎস থেকে এসেছে! এটা বড্ড আফসোসের বিষয়! তাই তো মানুষ পৃথিবীতে মারামারি, হানাহানি, খুন, খারাবি আরও যত রকম অপকর্ম আছে, করে যাচ্ছে।
শুধু কি তাই! তারা প্রকৃতির ভারসাম্যও নষ্ট করছে। নদী ভরাট করছে, বৃক্ষ কেটে ফেলছে, পশু পাখি নিধন করছে! পাখির কথা শুনে বৃক্ষ এবং নদী উভয় স্তব্ধ হয়ে গেল! কিছুক্ষণ পরে নদী বলল, তুমি একদম ঠিক বলেছ বন্ধু! কিন্তু আমাদের যে কিছুই করার নেই! আমরা যে নিরুপায়! কথাগুলো বলেই, প্রচন্ড কষ্টে, আক্ষেপে তিনজনই ডুকরে কাঁদতে লাগল! তারপর নদী তার কষ্ট নিয়ে আপন মনে প্রবাহিত হতে লাগল আর বৃক্ষ, এবং পাখি তাদের অস্তিত্ব নিয়ে চরম সংকট অনুভব করল!