রফিকুজ্জামান রণি :
গতরাতে হাফছা আবার এসেছিলো। অস্বাভাবিক চিন্তাক্লিষ্ট, বিষণœতায় ছাওয়া আর গোমড়ামুখো হাফছাকে এবার একেবারেই ব্যতিক্রম দেখাচ্ছিলো। হাফছাতো এমনিতেই অনেক কালো আর কুৎসিত চেহারায় জন্মেছে : তার উপরে আবার মুখে গোমড়া-বিষণœছায়া, গেলোরাতে সত্যিই যেন ভয়ানক কোনো প্রাণির অবয়ব নিয়ে ঘরে ঢুকেছে সে! এর আগেও অনেকবার এসেছিলো সে। কিন্তু এবারকার মতো এতটা ভয়ালরূপ ধারণ করে কখনোই আসেনি। বিদঘুটে কায়া আর মনমরা চেহারায় এর আগে তাকে কখনোই দেখা যায়নি। প্রত্যেকবারই হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, কৈশোরের চঞ্চলভাব নিয়ে সে ছুটে এসেছে। মেয়েটার মুখে সারাক্ষণ ঝুলে থাকতো একটা সরল¯িœগ্ধ হাসি। হাসিটাই তার একমাত্র অলংকার। রূপ-লাবণ্যহীন, লক্ষ্মীছাড়া, বেঢপ মেয়ে হাফছার হাসিমাখা মুখখানির দিকে ভালো করে একবার তাকালে কেউ কী বলতে পারবেÑ এ হাসি কুৎসিত কোনো মুখ থেকে উদিত হয়েছে? সেই মুখটা হঠাৎ শ্রাবণের মেঘের মতো এতো অন্ধকার কেন!
ভয়ংকর এক ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলো মুন্নী। অনাকাক্সিক্ষত স্বপ্নপটটা চোখের পর্দায় আঠার মতো লেগে আছেÑ মুন্নী সবেমাত্র দুপুরের খাবার প্রস্তুত করতে রান্না ঘরে ঢুকেছে। ঠিক তখনই বিজলি চমকানোর মতো হাফছার আগমন। নীরব-গম্ভীর হাফছা মুন্নীর পাশ-ঘেঁষে জলচৌকির ওপর মুখ লাল করে বসে পড়লো। চুপচাপ। কিঞ্চিৎ অবাক হলো মুন্নী।
‘হাফছা তুই এখানে! কখন এলি? কীভাবে এলি? তুই না..।’
একে-একে তিন-চার বার কথাটা উচ্চারণ করলো সে। উত্তর এলো না। মুখ ভার করে বসে রইলো। নির্লিপ্ত, নির্বিকার। মুন্নী খেয়াল করলো হাফছার কালো দুটি চোখের কনীনিকা ঘিরে রেখেছে বৃষ্টির স্ফটিকের মতো তীব্র জলের ফোঁটা। মুন্নী আবার কথা বলার চেষ্টা করলো। অজ্ঞাত কারণে সেমুহূর্তেই ঘুমটা কেটে গেলো। জেগে ওঠার পর ভয়ে শরীরে তার থরকাঁপুনি শুরু হলো।
জেগে ওঠার পর থেকেই বিষয়টা মুন্নীর মাথায় ওঠানামা করতে লাগলো। বুঝতে পারছে না হাফছা কেন তার সাথে বারবার এসে দেখা দেয়। হাফছার সাথে বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিলো এমন কথাওতো সে মনে করতে পারছে না। লেনদেনের ব্যাপার তো নয়-ই। বাড়ির উপরে সমবয়সী মেয়ে হিসেবে যতোটুকু সম্পর্ক থাকার কথাÑ ঠিক ততোটুকুই। তবে মাঝেমধ্যে দুয়ের মধ্যে সুখ-দুঃখের কথাই যা আদানপ্রদান হয়েছে কিছু। এরচে’ বেশি কোনো ভাব বিনিময় হয়েছে বলে মুন্নী মনে করতে পারছে না। তাহলে অন্যান্য সমবয়সী মেয়েদের বাদ রেখে তার সাথে হাফছা রাতের পর রাত এসে দেখা দেয়ার মানেটা কী?
প্রত্যন্ত-আবহে বেড়ে ওঠা মুন্নী শিক্ষিত বটে, তারপরও সমাজের প্রচলিত মিথ-প্রবচন এড়িয়ে চলার সাধ্য নেই তার। জন্মলগ্ন থেকেই শুনে আসছেÑ মৃতরা কবরে ভালো অবস্থায় থাকলে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় নিকটতম ব্যক্তিদের সাথে এসে দেখা দেয়। খারাপ অবস্থায় থাকলে বিষণœ-গম্ভীর মুখ নিয়ে কাছের লোকজনের সামনে এসে আশ্রয় খোঁজে। তাছাড়া মৃতব্যক্তি যার সাথে ঘনঘন দেখা দেয় তারও মৃত্যুর পারোয়ানা খুব দ্রুত জারি হয়ে যায়!
কিন্তু মৃত্যু-পারোয়ানা অথবা আপন-পরের হিসাবটা না হয় বাদই গেলো। চিন্তার কথা হচ্ছে, স্বপ্নযোগে হাফছা সারাজীবন তো হাসি হাসি মুখ নিয়েই মুন্নীর সামনে এসে ধরা দিয়েছে, আজ কেবল ব্যত্যয় ঘটলো। কোনোকালেই সে আনমনা হয়ে কিংবা মুখকালো করে মুন্নীর সামনে এসে দাঁড়ায়নি। তাহলে রহস্যটা কী? ঘুমঘোরে হাফছা প্রত্যেকবারই মুন্নীর সাথে এমন সব ইঙ্গিতবহ আচরণ করছে তাতে নিশ্চিতভাবেই ধরে নেওয়া যায় যে, মরহুমা হাফছা বেগম পরপারে স্বর্গবাসিনীই হয়েছে, সুখেই আছে পরজনমে। তবে আজ হঠাৎ ভিন্নরূপে আসার কারণ কী? মৃত্যুর পর তো কেউ স্বর্গচ্যুত হয়ে নরকে যাবে না। ধর্মের ব্যাখ্যামতে নরকবাসীরাই কেবল পদোন্নতি পেয়ে কখনো কখনো স্বর্গবাসী হয়। কিন্তু স্বর্গবাসীরা নরকবাসী হবে কোন যুক্তিতে? একবার কেউ স্বর্গবাসী হওয়া মানেই তো চিরতরে নরকাগ্নিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অনন্তকালের শান্তি কুড়িয়ে নেয়া!
সাধারণ একটা স্বপ্ন, একটা গোমড়া-বিষণœ চেহারার ইস্যু কিছুতেই মাথা থেকে নামাতে পারছে না মুন্নী। সারাদিনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে কথাটা বারবার মনের মধ্যে উঠানামা করতে লাগলো। একমুহূর্তের জন্যেও চিন্তাটা মাথাছাড়া করতে পারলো না সে। স্বপ্নের বিষয়ের সূত্রধরে জীবন চলার পথে সে হাফছার সাথে অমার্জিত কোনো আচরণ করেছে কিনা সেটাও ভাবতে লাগলো।
না। হাফছার সাথে কখনো রুক্ষ আচরণ করেছে এমন কোনো ঘটনা স্মরণে আসছে না। তাহলে কেন হাফছা এমন গম্ভীরভাব নিয়ে মুন্নীর সামনে এসে হাজির হলো? নানাবিধ চিন্তায় ডুব দিয়ে হাজারও স্মৃতির পৃষ্ঠা ঘাঁটাঘাটি করতে করতে ক্ষুদ্রতর একটা যুক্তিও দাঁড় করাতে মরিয়া হয়ে ওঠলো। মুহুর্মুহু অতীত ঘাঁটতে গিয়ে ছোট্ট একটা যুক্তি অবশ্য পেয়েও গেলো। তা হলো,Ñ
জন্ডিস আক্রান্ত হাফছার অকালপ্রয়াণের সংবাদটা যেদিন কানে আসে সেদিন পরম আক্ষেপ ঢেলে, ভেজা-রুষ্ট কণ্ঠে মুন্নী বলেছিলো, ‘মেয়েটা মরে গেছে ভালোই হয়েছে। স্বামী-সংসারের যন্ত্রণা, শ্বশুর-শাশুড়ির জ্বালাতন; অহরহ চোখরাঙানি থেকে অন্তত মুক্তি পেয়েছে। গরিব বাবা-মাকেও দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই দিয়েছে।’
তাহলে কি এই কথার উপর ভিত্তি করেই হাফছা মন খারাপ করে রেখেছে, রেগে আছে? এতে অভিমান করার কী আছে? কথাটাতো হাফছাকে কটাক্ষ করে অথবা অভিশম্পাত দিয়ে কিংবা তাকে ছোট করার জন্যে মুন্নী বলেনি। সেতো যৌতুকলোভী একটি ঘরে গৃহবধূ সেজে আসা কুৎসিত, কালো, অশিক্ষিত আর মিসকিনের মেয়ে খেতাবপ্রাপ্ত হাফছা নামের সরলসোজা একটি নারীর প্রায় চিকিৎসাহীন অপমৃত্যুকে ব্যঙ্গ করেই কথাটা বলেছিলো সেদিন।
পরক্ষণেই চিন্তার মোড় অন্যদিকে ঘুরলো। না না। মৃত্যুর পরও অনেকবার হাসিরাঙা মুখে স্বপ্নে মুন্নীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে। মরার পর তো তার শরীর পূর্বেকার তুলনায় অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিলো। স্বপ্নে তার হাসি জড়ানো মুখটা এতোই উজ্জ্বল দেখাচ্ছিলো যে তাতে চেনারই উপায় ছিলো না এটাই হচ্ছে ভাগ্যবিড়ম্বিত হাফছা নামের চিরদুখিনী কোনো নারীর মুখাবয়ব। হাফছার মৃত্যুর সংবাদে মুন্নীর মুখ-ফসকে বেরিয়ে আসা খেদোক্তি যদি তার মনে কষ্ট সঞ্চার করতো তাহলে কোনোকালেই সে ভালো চেহারায় মুন্নীর সাথে এসে দেখা দিতো না।
আচমকাই মুন্নীর মনের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠতে শুরু করলো হাফছার রেখে যাওয়া একমাত্র কন্যাশিশু নিপুর চেহারাটা। কালো মায়ের ঘরে এতো সুন্দর মেয়ে জন্ম নিয়েছিলো কোন পুণ্যের ফলে তা সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। তবে এই রূপের বিন্দু-অংশও যদি সৃষ্টিকর্তা হাফছাকে দিতেন তাহলে মেয়েটির জীবনের গতিপথ হয়তো অনেক উজ্জ্বল-সমৃদ্ধ হতো, অন্যদিকে মোড় নিতো তার ভাগ্যের স্রোতÑ এক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে নিরপেক্ষতার বালাই নেই বলে যদি কেউ হঠাৎ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠেÑ তা যে খুব বেশি অযৌক্তিক হবে তারই বা যৌক্তিকতা কোথায়?
হাফছার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া একমাত্র কন্যাশিশু নিপুর ওপর প্রথম প্রথম সবারই আদর-স্নেহ উত্থলে উঠেছিলো। কালপরিক্রমায় স্থির হয়ে গেছে সব। জীবন্মৃত পিতা এবং মাতৃহীন শিশুকন্যাটির দায়িত্ব শেষমেশ হাফছার পিতা-মাতার ঘাড়েই পড়েছিলো। অভাব এবং পার্থিব বাস্তবতা সকল স্নেহ-মমতাকে হালকা করে দেওয়ার জন্যে কী চিরকালই ওঁৎপেতে থাকে? নিপুর ভাগ্য ধীরে ধীরে অনিশ্চয়তার দিকে প্রবাহিত হতে লাগলো। টানাপড়নের সংসারে অনেকদিন যতœ-আত্তি মিললেও সময়ের ব্যবধানে অনাথ শিশুটি যে আগের তুলনায় ভালো আছে সে কথা কোনো যুক্তিতেই দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। তাহলে কী মাতৃ¯েœহের ক্ষুধা নিয়ে পরগাছার মতো বেড়ে ওঠা শিশুকন্যা নিপুর অবহেলিত জীবনের বীভৎস ভবিষ্যৎ কল্পনা করেই হাফছা অশান্তিতে ভোগে? পৃথিবীতে রেখে যাওয়া অবুঝ কন্যার মায়ার আগুনই কী তাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে দগ্ধ করছে? স্বর্গবাসী মা হাফছা বেগম মর্ত্যরে বুকে রেখে যাওয়া নিজের একমাত্র সন্তানের পার্থিব-নরকবাস আর পরিচয়হীন বেড়ে ওঠার যন্ত্রণা উপলব্ধি করেই কী মুখ মলিন করে রেখেছে?
যুক্তিযুক্ত, যুক্তহীন হারকিসিমের চিন্তা এসে ভর করায় মুন্নীর মাথাটা বিকল হওয়ার যোগাড় হলো। এর বাইরেও তার মাথায় অসংখ্য চিন্তা-যুক্তি এসে জেঁকে বসলো। স্বপ্নের কোনো কূলকিনারা সে পেলো না। অতিমাত্রায় স্মৃতিকাতরতার চাপে শরীর ঝিমুনি ধরতে শুরু করলো। কোথাও চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো। বিছানায় লুটিয়ে পড়লো। খেয়াল পড়লো শরীরে তার ভীষণ জ্বরের আনাগোনা।
দুদিন যাবৎ জ্বরে-ভোগা শরীরটা আজ একটু ভালো লাগছে। একটু হালকা হালকা লাগছে নিজেকে। এরই মধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেলো। বিনা নোটিসে মুন্নী অসুস্থ হয়ে পড়ায় বাড়ির লোকজন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলো। সবার কাছেই বিষয়টা এড়িয়ে চললো সে। একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্বপ্নের কথাটা বড় বোন রানুকে খুলে বললো সে। রানুর অতিমাত্রায় খোঁচাখুঁচিতে না বলে পারলো না। সবকিছু মন দিয়ে শোনার পর একটুও বিচলিত না হয়ে, র্দীঘশ্বাস গোপন করে এবং কৃত্রিম একটা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে রানু বলে ওঠলো, ‘তাতে মন খারাপের কী আছে রে বোকা। হাফছারা কী আর চাইলেই মরতে পারে! তারা যে বাঁচতেও পারে না মরতেও পারে না। তারাইতো বারবার ফিরে ফিরে আসে। আমাদের লীমাও কি কম যন্ত্রণা নিয়ে কবরে ঢুকেছে? ওসব ভেবে অযথা মন খারাপ করিস না রে বোন। সবকিছুতেই স্বাভাবিক দৃষ্টি ফেল, ভালো থাকবি।’
ছোট বোনকে সান্ত¡নার ছলেই হোক কিংবা নিজের বুদ্ধিমত্তার জোরেই হোক, রানুর বলা কথাটা মুন্নীকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করলো।
স্বল্পশিক্ষিত বোনের সাথে আলাপচারিতায় হাফছা হাসিমাখা মুখ কিংবা গোমড়ামুখো চেহারায় স্বপ্নে এসে দেখা দেওয়ার রহস্যটা উন্মোচন করতে না পারলেও বড় বোন রানুর কথার শরীর থেকে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ একটা তথ্য মুন্নী ঠিকই ছেঁকে আনতে সক্ষম হয়েছে। রানুর একটামাত্র বাক্য তার সব চিন্তার বেদীতে কম্পন ধরিয়ে দিলো।
ঘুরেফিরে কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হলো বাক্যটা,Ñ ‘হাফছারা কী আর চাইলেই মরতে পারে!’
পূর্বের চিন্তাটা মাথা থেকে বড় বোনের সামান্য একটা বাক্যের ধাক্কায় হারিয়ে গেলো। কিন্তু মাথা-চেপে বসলো নতুন এক চিন্তা, অন্য এক প্রহেলিকা!
‘হাফছারা কী আর চাইলেই মরতে পারে!’Ñ এই নির্মম এবং চিরায়ত কথাটা ভাবতে ভাবতে মুন্নী নিজে নিজেই হিসেব মিলিয়ে দেখলো, সত্যিইতো হাফছারা মরে না! চাইলেও যে তারা মরতে পারে না। যুগ যুগ ধরে নশ্বর পৃথিবীতে দুর্বিষহ জীবন নিয়ে টিকে থাকে একমাত্র হাফছারাই। তারা যে কচ্ছপের চেয়েও দীর্ঘ জীবন নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়। তাই ক্ষণিকের জন্যে আড়ালে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করেও অগোচরে হাফছারাই তো আমাদের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে বারবার।
তারা হাসলেই কী, আর কাঁদলেই বা কী!
লক্ষ বছরের পৃথিবীতে শাপ-পরম্পরায় প্রতিদিন-প্রতিক্ষণে হাফছাদেরকেই তো আমরা নেমে আসতে দেখিÑ ভিন্ন কোনো নামে, ভিন্ন কোনো রূপে, ভিন্ন কোনো উপকথায় কিংবা ভিন্ন কোনো পরিচয় নিয়ে…!!!