পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক উপস্থাপনা
নির্মাণ ব্যয় বাড়বে পাঁচগুণ
অপেক্ষা বাড়বে ২০২৭ পর্যন্ত
নিজস্ব প্রতিবেদক »
ডিসেম্বরে কর্ণফুলীর তলদেশ দিয়ে টানেল চালু হলেও চট্টগ্রামবাসীর স্বপ্নের কালুরঘাট সেতু দীর্ঘতর হচ্ছে। সেতু নির্মাণের প্রাথমিক নকশায় পদ্মা সেতুর আদলে নিচে রেল লাইন ও ওপরে সড়ক পথের মাধ্যমে তৈরি করতে খরচ হবে পাঁচগুণের বেশি টাকা। আগেকার নকশায় সেতুর নির্মাণ খরচ ধরা হয়েছিল ১২০০ কোটি টাকা, আর প্রস্তাবিত নকশায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। নির্মাণে সময় লাগতে পারে কাজ শুরুর পর চার বছর।
সেহিসেবে আগামী বছর কাজ শুরু করলেও তা শেষ হতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত লাগতে পারে। গতকাল পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের সদরদপ্তর সিআরবি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত এক সভায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের নকশা উপস্থাপন করেন।
তবে তাদের এই নকশা চূড়ান্ত নয় স্বীকার করে পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, এটা শুধুমাত্র প্রস্তাবিত নকশা। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের রিপোর্ট জমা দেয়ার পর এটা নিয়ে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত নকশা প্রণয়ন করে ডিপিপি ( বিস্তারিত প্রকল্প প্রস্তাবনা) তৈরি করে অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে। পরবর্তীতে ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদন, প্রি-একনেক ও একনেকে অনুমোদন শেষে ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহবান করা হবে।’
সভায় উপস্থিত থাকা বোয়ালখালী এলাকার সংসদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘দাতা সংস্থা কোরিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত এক্সিম ব্যাংকের নিয়োগ করা প্রতিষ্ঠান ইওসিন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন প্রাথমিক সমীক্ষা শেষে সেতু নির্মাণের স্থান, নকশা, ব্যয় ও নির্মাণকাল নিয়ে প্রাথমিক প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন। এই প্রস্তাবনায় পদ্মা সেতুর আদলে কালুরঘাট সেতুর ডিজাইন করা হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন,‘ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদন আগামী মাসে মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। জমা দেবার পর ডিপিপি অনুমোদন সাপেক্ষে একনেকে অনুমোদন পেলে আগামী বছরে হয়তো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা যাবে।’
তিনি আরো বলেন, প্রস্তাবিত নকশায় সেতু নির্মাণ করতে চার বছর লাগবে। সেহিসেবে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এ বিষয়ে কথা হয় কালুরঘাট সেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম মোস্তফার সঙ্গে। তিনি বলেন,‘ এই নকশাটি প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিজাইন যাচাই-বাছাই করতে বিভিন্ন জনের সাথে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করছেন। তারা এমনই একটি প্রতিবেদন আমাদের রেলওয়ে কর্মকর্তাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তীতে আরো যাচাই বাছাই শেষে তারা আগামী মাসে পরামর্শ প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ডিপিপি তৈরি করবে। এরপর ধারাবাহিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।’
প্রস্তাবিত নকশায় যা রয়েছে?
সেতুর ওপরে থাকবে দুই লেইনের সড়ক এবং নিচে থাকবে দুই লেইনের রেললাইন। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান কালুরঘাট সেতু থেকে ৭০ মিটার উজানে অর্থাৎ উত্তরে নতুন সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। পূর্বের নকশায় সেতুর ব্যয় ছিল ১২০০ কোটি টাকা। সেতু নির্মাণের সম্ভাব্য সময় ধরা হয়েছে কাজ শুরুর সময় থেকে চার বছর।
প্রস্তাবিত নকশায় সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ৭৮০ মিটার। এর মধ্যে নদীর বাইরে স্থলপথে থাকবে ৫ দশমিক ৬২ মিটার। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য হবে ১০০ মিটার। মোট পিলার থাকবে ৮টি। সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। এর ওপরের ডেকে থাকবে সড়ক এবং নিচের ডেকে রেললাইন। উভয়ই হবে দ্বিমুখী অর্থাৎ দুই লেইনের। সড়কে হেঁটে পারাপারের জন্য দুইপাশে আলাদা লেন থাকবে।
সেতুর ব্যয়
সেতুর জন্য প্রস্তাবিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা। কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) সহজ শর্তে পুরো টাকা বাংলাদেশ সরকারকে ঋণ হিসেবে দিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন। তিনি বলেন,‘ সেতু নির্মাণের সব অর্থ দাতা সংস্থা দেবে। বাংলাদেশ সরকার শুধু ভূমি অধিগ্রহণের ব্যয় বহন করবে।’ পূর্বের নকশায় ব্যয় ছিল ১২০০ কোটি টাকা।
পূর্বের খরচের তুলনায় এবার বেশি ব্যয় প্রসঙ্গে রেলওয়ে কর্তারা জানান, আগের নকশার সঙ্গে এখনকার নকশা মেলালে হবে না। আগে ছিল এক ডেকে রেল ও সড়ক সেতু। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে পদ্মা সেতুর আদলে দ্বিতল সেতু। আগের নকশায় সেতুর নেভিগেশন হাইট ধরা হয়েছিল ৭ দশমিক ৬ মিটার। এখন প্রস্তাব করা হয়েছে ১২ দশমিক ২ মিটার। এছাড়া সেতু করা হবে বিদ্যমান সেতুর ৭০ মিটার উজানে। তখন ১২০০ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছিল। নকশায় যেহেতু ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যয় বেড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে।
সময় কতো লাগবে?
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, একনেকে অনুমোদন, দরপত্রসহ আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে তারা সেতুর কাজ শুরু করতে পারবে। সেক্ষেত্রে সেতুটি নির্মাণ শেষ হতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে।
সেতুর উভয় প্রান্ত
নদীপথে সেতুর ওপরের অংশ পার হয়ে স্থলভাগে সড়ক হবে অর্ধবৃত্তাকারে। এর এক প্রান্ত থাকবে চট্টগ্রাম নগরীর কাপ্তাই রাস্তার মাথার অদূরে জানালী হাট রেলস্টেশন পার হয়ে মূল সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত। আরেক প্রান্ত থাকবে বোয়ালখালী অংশে বিদ্যমান কালুরঘাট সেতুর সংযোগ সড়কের সঙ্গে, তবে বর্তমান সংযোগ থেকে কিছুটা দূরে। আর ডাবল রেললাইনের একাংশ শুরু হবে জানালী হাট থেকে, এর অপর অংশ থাকবে বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী রেলস্টেশনে।
কালুরঘাট সেতুর ইতিহাস
১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বার্মা ফ্রন্টের সৈন্য পরিচালনা করার জন্য কর্ণফুলী নদীতে ব্রিজ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৩০ সালে ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি ব্রিজ বিল্ডার্স নামে একটি সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিজটি নির্মাণ করে। মূলত ট্রেন চলাচলের জন্য ৭০০ গজ লম্বা সেতুটি ১৯৩০ সালের ৪ জুন উদ্বোধন করা হয়। পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুনরায় বার্মা ফ্রন্টের যুদ্ধে মোটরযান চলাচলের জন্য ডেক বসানো হয়। দেশ বিভাগের পর ডেক তুলে ফেলা হয়। ১৯৫৮ সালে সব রকম যানবাহন চলাচলের যোগ্য করে ব্রিজটির বর্তমান রূপ দেওয়া হয়। বৃটিশ আমলে নির্মিত ব্রিজটির রয়েছে ২টি এব্যাটমেট, ৬টি ব্রিক পিলার, ১২টি স্টীল পিলার ও ১৯টি স্প্যান। জরাজীর্ণ একমুখী সেতুটিতে ট্রেনের পাশাপাশি যানবাহনও চলে। বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের একাংশের নগরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম এই কালুরঘাট সেতু। একমুখী সেতুর একপাশে গাড়ি উঠলে আরেকপাশ বন্ধ থাকে। ফলে দীর্ঘ যানজটের ভোগান্তি চলছে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাটে বিদ্যমান সেতুটি প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। পুরনো এই সেতুর কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইন চালু দীর্ঘায়িত হচ্ছে। তাই নতুন সেতু নির্মাণ সময়ের দাবি ছিল। রেললাইনের কাজ প্রায় শেষ হলেও এই সেতুর কারণে চলতি বছর কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চালু নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।