নোঙর ছেঁড়া

সাগর আহমেদ »

দিনটি ছিলো শুক্রবার। স্কুল ছুটির দিন । চট্টগ্রাম বন্দরে স্থির পানিতে একটি ছোট জাহাজ বা স্কুনার নোঙর করা আছে। জাহাজটির নাম অ্যাডভেঞ্চার। কথা ছিলো কয়েকটি স্কুলের বাচ্চারা শিক্ষকদের সাথে মিলে একসাথে সমুদ্র ভ্রমণে বের হবে। সব ঠিকঠাক। কিন্তু হঠাৎ সেদিন আবহাওয়ার সতর্ক সংকেত। সমুদ্রে নাকি গভীর নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার রাত নাগাদ এটি ঝড়, বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাস রূপে চট্টগ্রাম উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানবে। কাজেই শিক্ষকরা যখন এ কথা শুনলেন তখন সমুদ্র ভ্রমণ কয়েক দিনের জন্য স্থগিত হলো। সমুদ্র ভ্রমণে যাবার জন্য সম্পূর্ণ রেডি ছিলো চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ক্লাস এইটের তিন বন্ধু অপু, তিয়ান আর টিয়ানা। ওদের মধ্যে অপু নেতা গোছের। তার পকেটে সবসময়ই থাকে বড় বড় মার্বেল আর কোমড়ে ঝোলানো থাকে পেল্লাই সাইজের একটা গুলতি।এই গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করতে সে খুব পছন্দ করে। ওরা তিন বন্ধু সবাই বহদ্দারহাটে একই পাড়ায় থাকে। নৌ ভ্রমণ স্থগিত হওয়ায় তিন জনেই খুব মন খারাপ করলো। বিকেলের দিকে খেলার মাঠে বাকি দু’জনের দেখা পেয়ে অপু বললো, ‘চল,জাহাজটাতে একবার ঘুরে দেখে আসি।’ তিয়ান আর টিয়ানা মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হয়ে গেলো। বন্দরে পৌঁছে তারা তাদের ছোট্ট জাহাজে অ্যাডভেঞ্চার পেয়ে গেলো । তারা তিনজন গ্যাংওয়ের সিঁড়ি বেয়ে জাহাজের ভেতরে ঢুকে গেলো।
ঢুকে তো তারা মুগ্ধ। টিয়ানা বললো, ‘ওমা! কি সুন্দর জাহাজের ভেতরটা!’ বাকি দু’জনে নিরবে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো । তারা প্রথমেই প্যান্ট্রি বা খাবার রাখার ঘরে গেলো। দেখলো সেখানে প্যাকেটজাত ও বোতলজাত রাশিরাশি খাবার রয়েছে। ওদের পছন্দেও স্ক্যানডেনেভিয়ান চকলেটও আছে অনেকগুলো বক্সে। আছে বাচ্চাদের জন্য আরো নানা রকম সুস্বাদু খাবার ও বিস্কিট। এরপর ওরা কম্প্যেনিয়ন ওয়ে বেয়ে ডেক বা জাহাজের ছাদে উঠলো। ছাদে উঠে ওরা সমুদ্রের এলোমেলো দমকা বাতাস উপভোগ করতে লাগলো। এমন সময় আকাশে দেখা মিললো একটা বড় বাজপাখির। ওটা ছো মেরে নিচের লিকে নামছে । ভয় পেয়ে গেলো অপু । সে গুলতিতে মার্বেল জুড়ে সরাসরি ছুড়লো পাখিটার বুক বরাবর । পাখিটা দাপটাতে দাপটাতে ডেকে এসে পড়লো । প্রাণ নেই। টিয়ানা রেগে গেলো । অপুকে চেঁচিয়ে বললো, ‘ওটাতো মাছ শিকারের জন্য নিচে নামছিলো, তুমি ওকে মারলে কেন?‘ অপু মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো, ‘ভেবে ছিলাম আমাদের আক্রমণ করতে আসছে।’ দু’জনকে গম্ভীর দেখে তিয়ান বললো, ‘রাখ তো, এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট। চল আমরা নিচে জাহাজের বার্থ বা শোয়ার যায়গাগুলো দেখে আসি‘, তিয়ান বললো, ‘তাই চল।’ ততক্ষণে বাতাসের বেগ বেড়েই চলছিলো। কিন্তু গল্প-গুজবে মেতে থাকায় তিনবন্ধু খেয়ালই করলো না। ওরা কম্প্যেনিয়ন ওয়ে বেয়ে নিচে নেমে প্রথমেই ঢুকলো রান্না ঘর বা গ্যালিতে। কতগুলো বড় বড় ছুরি তাঁদের চোখে পড়লো। তিয়ানের একটা ছুরি খুব পছন্দ হলো । গ্যালি থেকে বের হওয়ার সময় সে একটা ছুরি নিজের হাতে নিলো আনমনে। এরপর তারা গেলো শোবার ঘর বা বার্থ দেখতে । অনেক গুলো সুন্দর সুন্দর ফোমের তৈরি বিছানা ফ্লোরে পেতে রাখা আছে । ততক্ষণে রাত হয়েছে। টিয়ানা ক্লান্তিতে হাই তুললো একটা, তারপর বললো, ‘অনেকটা এনার্জি লেস হয়ে গেছি, তোদেরও ক্লান্ত লাগছে, চল, আমরা শুয়ে একটু জিরিয়ে নেই । ‘সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে নরম বিছানাগুলোতে শুয়ে পড়লো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো । ওদিকে বাতাসের বেগ বেড়েই চললো। যখন দমকা বাতাসও সমুদ্র উত্তাল হয়ে ঝড় উঠলো, ওরা সবাই জাহাজের দুলুনিতে জেগে উঠলো। কিন্তু তখন আর কিছু করার ছিলো না। জলোচ্ছ্বাসের উন্মত্ততায় জাহাজ নোঙর ছিঁড়ে ভেসে চললো সাগরের অজানা গন্তব্যে। অপু, তিয়ান ও টিয়ানা সৃষ্টিকর্তার নাম জপতে লাগলো । সারারাত ধরে ঝড় তুফান চললো। ভোরের দিকে ঝড় থামলো। সাগর শান্ত হয়ে এলো। ওরা গ্যাংওয়ে ধরে নিচে নেমে দেখলো জাহাজ একটি নির্জন দ্বীপের বালুচরে আটকে আছে । তিয়ান ও টিয়ানা ভয় পেয়ে গেলো । অপু তাদের সাহস দিলো । সে বললো, ‘জাহাজযে খোলা সমুদ্রে ভেসে গেছে, তা বাংলাদেশ নৌ কর্তৃপক্ষ এতক্ষনে জেনে গেছে। চলো আমরা জাহাজের মাস্তলে সাদা পতাকা উড়িয়ে দিই। কোনো উদ্ধারকারী জাহাজ বা হেলিকপ্টার সেটি দেখে নিশ্চয়ই আমাদের উদ্ধার করতে এগিয়ে আসবে।’
সবাই মিলে তাই করলো। তারপর ছয়দিন কেটে গেছে। জাহাজের খাবার ফুরিয়ে গেছে। সবাই বাধ্য হয়ে শিকারের সন্ধানে তীরে নামলো । একটু দূরে যেতেই কোত্থেকে যেনো একটা কেউটে সাপ এসে টিয়ানাকে ছোবল মারতে উদ্যত হলো। অপু চোখের পলকে গুলতিতে মার্বেল জুড়ে সাপের মাথা সই করে মারলো। নিখুঁত লক্ষ্য ভেদ। সাপটি মাটিতে পড়ে ছটফট করতে লাগলো। তিয়ান তখন একটা বড় মাটির ঢেলা দিয়ে সাপটির মাথা গুড়িয়ে দিলো। চারিদিকে নারকেল গাছসহ বিভিন্ন গাছপালা। অনেকটা বনের মতো । ওরা এগিয়ে চললো। বেশ কিছুদূর যেতে ওরা উঁচু গাছের ডালে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কতগুলো বনমোরগ বসে থাকতে দেখলো। অপু সাথে সাথে গুলতিতে মার্বেল জুড়ে একটা বনমোরগকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলো । মোরগটি নিচে পড়তেই তিয়ান আর টিয়ানা ওটিকে ধরে ব্যাগে ভরে নিলো । আজকের মতো খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে । ওরা খুশি মনে ফেরার পথ ধরলো । কিন্তু কিছুদূর যেতেই একদল বন্য বানর চারিদিক থেকে তাদের আক্রমণ করলো। অপু একটার পর একটা মার্বেল ছুড়তে লাগলো গুলতি দিয়ে। তিয়ান ও টিয়ানা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে বানরের দলের সাথে যুদ্ধ করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পরেই বানরের দল পরাজয় মেনে নিয়ে পালিয়ে গেলো। তিয়ানরা পথে নারকেল গাছ থেকে বেশকিছু ডাব সংগ্রহ করে জাহাজে ফিরে এলো । তারা ক্ষুধা ও পিপাসায় ক্লান্ত ছিলো। তিয়ান তার ধারালো ও মজবুত চাকুটি দিয়ে ডাব কেটে সবাইকে পানি খাওয়ালো। তারপর গ্যালিতে গিয়ে সবাই মিলে মোরগটাকে রান্না করে খেলো। খেয়ে দেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে সবাই সমুদ্রের পাড়ে হাঁটতে বের হলো । টিয়ানা কতগুলো ঝিনুক দেখে বললো, ‘আহা,কি সুন্দর!‘ হঠাৎ দূরে একটা জাহাজ দেখা গেলো। অপু দৌড়ে তাদের জাহাজ থেকে পতাকা নিয়ে এসে সজোরে নাড়তে লাগলো। বাকি দু’জন চিৎকার জুড়ে দিলো । মনে হলো জাহাজের লোকজন তাদের দেখতে পেয়েছে। জাহাজটি কাছে এলে তারা দেখলো জাহাজটির নাম বাংলার প্রত্যাশা । এটি নৌবাহিনীর একটি জাহাজ। ক্যাপটেন নিজে নেমে এসে ওদের জাহাজে স্বাগত জানালেন । তিনি বললেন, ‘তোমাদের খুঁজতে খুঁজতে আমরা এখানে এসেছি। এ দ্বীপটির নাম ঘাসিয়ার দ্বীপ ।’ তারপর জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে চললো। অপু, তিয়ান ও টিয়ানা অবশেষে বাসায় ফিরতেই তাদের বাবা, মা যেনো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তারপর যে তারা ওদের কতো আদর আপ্যায়ন করলেন, তা আর কী বলবো।