দীপন বিশ্বাস, কক্সবাজার »
গণহত্যার বিচার ও নিজ দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা বিশাল সমাবেশ করেছে। গতকাল শুক্রবার সকাল নয়টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ইস্ট -১ এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে উখিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা সমাবেশে যোগদান করে। এ সময় তারা (রোহিঙ্গারা) দ্রুত মিয়ানমারের ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে বক্তব্য রাখেন।
সমাবেশে বক্তব্য দেন রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবাইর, সৈয়দুল আমিন, মাস্টার মুসা, সৈয়দ উল্লাহ, মাস্টার রফিক, কামাল উদ্দিন, মাস্টার শোয়াইব ও শাহিদা।
এ সময় তারা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানান। সমাবেশে তারা নির্মম গণহত্যার বিচার ও বাপদাদার ভিটায় ফেরার দাবি জানান। উখিয়ার ৯,১০১১,১২,১৩,১৪,১৭ ১৮ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং টেকনাফের জাদিমুরা ক্যাম্পে পৃথক এসব সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে ইংরেজিতে লেখা একটি লিফলেট প্রচার করা হয়। সেখানে তারা উল্লেখ করে- ‘আজ যখন আমরা রোহিঙ্গা গণহত্যা স্মরণ দিবসের ৬ষ্ঠ বার্ষিকী স্মরণে জড়ো হয়েছি, তখন আমাদের সেই ট্র্যাজেডির ক্ষণগুলো খুব বেশি তাড়িত করে চলেছে। এ দিনটি ক্ষতি, দুর্ভোগ এবং অকল্পনীয় নৃশংসতার বেদনা স্মরণ করিয়ে দেয়।
দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রত্যেক রোহিঙ্গাকে আরাকানের গ্রামে গ্রামে প্রত্যাবাসন, প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত প্রত্যেক চুক্তি ও প্রক্রিয়ায় অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ওআইসি, যুক্তরাজ্য, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, বাংলাদেশ, এনজিও, সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা, বার্মার ১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইন বাতিল, সম্পত্তি ফেরত, স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার অধিকারসহ নানা দাবি উত্থাপন করা হয়।
এদিনে আমাদের মনে পড়ে সেই বর্বরতার ভয়ঙ্কর দৃশ্য- যেখানে আমাদের সন্তানদের পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল ঘরবাড়িতে, অগণিত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছিল, আমাদের মা-বোনদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, বাড়িঘর এবং আমাদের গ্রামে আগুন দেওয়া হয়েছিল। নিরপরাধের জীবন ও ভবিষ্যৎ কেড়ে নেয়া হয়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি বেঁচে থাকা, সাক্ষী এবং গণহত্যার শিকার হিসেবে। সেই মর্মান্তিক দিনের পর ছয় বছর পার হয়ে গেছে তবুও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ন্যায়বিচারের সন্ধান অধরা। আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, ন্যায়বিচারের পথ এত কঠিন কেন? যত দিন যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের আস্থা কমছে।
আমাদের আশাগুলো বাংলাদেশের অবিচল অংশীদারিত্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, আসিয়ান এবং বিশেষ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টায় নোঙর করে। আমরা আসন্ন গ্রীষ্মের মধ্যে নিরাপত্তা এবং মর্যাদার নিশ্চয়তাসহ আমাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন করতে চাই।
উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও নারী নেতা শাহিদা বলেন, যত তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে চাই। নিজেদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। একই কথা বলেন লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা মাস্টার শোয়াইব।
রোহিঙ্গা নেতা ডা. জুবায়ের বলেন, সম্মানজনক প্রক্রিয়ায় আমরা নিরাপদ প্রত্যাবাসন চাই। আমাদের আশা সমাবেশে উত্থাপিত রোহিঙ্গাদের যৌক্তিক দাবিগুলো আন্তর্জাতিক পরিম-লে গুরুত্ব পাবে।
টেকনাফের মুচনি ক্যাম্পের মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের মূল দাবি সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে আমরা নিজ মাতৃভূমি মিয়ানমারে ফিরতে চাই। বাংলাদেশ সরকার আমাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিক দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। আমরা কৃতজ্ঞ। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে শান্তিপূর্ণ ভাবে দাঁড়িয়ে নিজ দেশে বাড়ি ফিরার আকুতি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মহাসমাবেশ হয়। কিন্তু ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দুর্বৃত্তের গুলি নিহত হন রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন স্বপ্ন দেখানো নেতা মুহিবুল্লাহ। ২০১৮ সালের দিকে সাধারণ রোহিঙ্গাদের নেতা হিসেবে আবির্ভাব হয় মাস্টার মুহিবুল্লাহর। আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস নামের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার ফেরত নিয়ে যেতে সংগঠিত করেছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বেশ জোরালো জনমত গড়ে তুলেছিলেন।
তিনিই শুরু করেছিলেন ‘গুয়িং হোম’ ক্যাম্পেইন। কিন্তু প্রত্যাবাসন বিরোধী রোহিঙ্গাদের একটি চক্র ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর উখিয়ার লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকে সংগঠনের কার্যালয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করে। তিনি নিহত হবার পর এ ধরণের সমাবেশে একক কোনো আয়োজক কিংবা নেতৃত্ব পর্যায়ের কেউ সামনে আসছেন না। তবে প্রচারপত্রে আয়োজক হিসেবে ‘নির্যাতিত সাধারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী’ লেখা হয়েছে।