সুপ্রভাত ডেস্ক »
নিউ ইয়র্কে পাড়ি জমানো চট্টগ্রামের এক অভিবাসী দম্পতির ঘরে জন্ম তার। বড় হয়েছেন নাইন-ইলেভেন পরবর্তী মুসলিম-বিদ্বেষের মধ্যে। জটিল লুপাস রোগের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে ফিরে এসেছেন মৃত্যুর কোল থেকে। এরপরও মাত্র ৩০ বছর বয়সে প্রথম মুসলিম নারী ও দক্ষিণ আমেরিকান বংশোদ্ভূত হিসেবে নিউ ইয়র্কের সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছেন।
সম্প্রতি নিজের বেড়ে উঠা, ব্যক্তিগত সংগ্রাম ও রাজনৈতিক জীবন নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ডেইলি কসে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন শাহানা। পাঠকদের জন্য সে সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো-
প্রশ্ন: বাংলাদেশি আমেরিকান মুসলমান হিসেবে বেড়ে ওঠাটা আপনার রাজনীতিতে প্রবেশ করার সিদ্ধান্তে কতটা প্রভাব ফেলেছে?
শাহানা: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ব্রুকলিনের সবচেয়ে বড় শ্রমজীবী বাংলাদেশিদের আখড়া, কেনসিংটনে। তাই অন্য কোনো জায়গায় রাজনীতিতে যোগ দেওয়াটা আমি কল্পনাই করতে পারি না।
ব্রুকলিনে একজন বাংলাদেশী আমেরিকান মুসলিম হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতাই আমার ভিতরের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে জাগ্রত করেছে, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছে আজকের আমি।
কেনসিংটনের বাংলাদেশি সম্প্রদায়, শ্রমজীবী দক্ষিণ এশীয় সম্প্রদায় এবং নিউ ইয়র্কের মুসলিম সম্প্রদায়; আমরা বহুদিন ধরেই নগর সরকারের কাছে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হয়ে আসছি। তাই পরিবর্তন আনতে এবং সকল সম্প্রদায়ের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলোর জন্য স্থানীয়ভাবে লড়াই করতে আমি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি।
প্রশ্ন: নিউইয়র্ক শহরের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে সিটি কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছেন আপনি। এর তাৎপর্য কতটুকু?
শাহানা: নাইন-ইলেভেনের সময় রাজনীতির সঙ্গে সংযোগ হয় আমার। এবং আমার মুক্তির লড়াইয়ের একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিম আমেরিকান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষমতায়ন করা।
নাইন ইলেভেনের পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সম্প্রসারিত হোমল্যান্ড সিকিউরিটি মুসলিম পরিবার, সংগঠন, ক্যাম্পাস এবং মসজিদগুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে নজরদারি চালাতে শুরু করে। তখন এলাকার মুসলমান ছেলে-মেয়েদের নিয়ে একটি কাজ করি আমি- তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে সুরক্ষা চেয়ে একটি চিঠি লেখি। সেখানে নজরদারি এবং বৈষম্যমুক্ত একটি শহরে বড় হতে চাওয়ার আবদার জানাই আমরা।
বুশ কখনো আমাদের চিঠির জবাব দেননি। কিন্তু আমরা একসাথে কাজ করা অব্যাহত রাখি। কারণ ততদিনে আমরা বুঝে ফেলেছি যে নিজেদের পরিবার ও একে অপরকে সুরক্ষিত রাখতে হবে আমাদেরকেই।
বহু বছর পর, ক্রমাগত বর্ণবাদী সহিংসতার মাঝে আমি ‘মুসলিম রাইটার্স কালেক্টিভ’ নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করি। এর মাধ্যমে নিউইয়র্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ মুসলমানরা তাদের গল্পগুলো বলার, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার একটি প্লাটফর্ম পায়। আমার এই জয়ের পিছনেও রয়েছে মুসলিম নারীবাদীদের সংগঠিত হওয়ার গভীর ইতিহাস।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে শাহানার দেহে লুপাস ধরা পড়ে। লুপাস বা এসএলই (সিস্টেমিক লুপাস ইরাইথেমেটোসাস) এমন একটি ব্যাধি যার ফলে দেহের রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা নিজের শরীরের বিভিন্ন কোষের বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে। যে কারণে দেহের ত্বক, মাংসপেশি থেকে শুরু করে হৃৎপিণ্ড, কিডনিসহ সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গই ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে।
শাহানা বলেন, “লুপাসের জন্য আমি মরতেই বসেছিলাম। এই রোগের জন্য কয়েক মাস ধরে আমার কেমোথেরাপি নিতে হয়। আমার সব চুল পরে যায়, দীর্ঘস্থায়ী একটি জয়েন্টের রোগও তৈরি হয়। হাসপাতাল ও বাড়ি মিলিয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী হয়ে থাকতে হয় আমার।”
শাহানা যখন জীবনের জন্য যুদ্ধ করছেন, তখন তার অভিবাসী বাবা-মা যুদ্ধ করছেন একটি ভগ্ন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ও জটিল আমলাতন্ত্রের বেড়াজাল পেরিয়ে কীভাবে মেয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যায়, তা নিয়ে।
বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে উন্নত করার লড়াইয়ে যোগ দেওয়া শাহানা জানান, এই লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা লুপাসের বিরুদ্ধে করা তার সংগ্রাম থেকেই এসেছে।
স্বাস্থ্যসেবা, ভাষার অ্যাক্সেসের পাশাপাশি শাহানার আরেকটি অগ্রাধিকারের জায়গা হচ্ছে জনশিক্ষা। নিজ অভিজ্ঞতা থেকে শাহানা জানান, নিউ ইয়র্কের পাবলিক স্কুলগুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া বেশ “বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী”।
যে কারণে স্থানীয় পাবলিক স্কুলগুলোকে একীভূত করার পক্ষে শাহানা। স্কুল একীভূত করার পাশাপাশি সবার জন্য সমান শিক্ষা ও শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
সবশেষে, কোনো তরুণ দক্ষিণ এশীয় বা মুসলিম নারী রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চাইলে কী উপদেশ দিবেন, এমন প্রশ্নের জবাবে শাহানা বলেন, “বিশ্বাস রাখুন।”
“নিজের অভিজ্ঞতা এবং কণ্ঠস্বরের উপর বিশ্বাস রাখুন। একটি ভালো দল গড়ে তুলুন, যেখানে আপনার বন্ধু-বান্ধব, পরিবারের সদস্য এবং সম্প্রদায়ের লোকদের একটি সমর্থন ব্যবস্থা থাকবে। অন্যান্য দক্ষিণ এশীয় এবং মুসলিম সংগঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন। এবং স্ট্যাসি আব্রামসের ‘আওয়ার টাইম ইজ নাউ!’ বইটি পড়তে ভুলবেন না।”
সূত্র : টিবিএস