ড. আনোয়ারা আলম »
বিশ শতকের মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড ষখন বলেন-‘শরীর ই নিয়তি’ তখন পুরুষতন্ত্র স্বস্তি বোধ করলেও নারীর জীবন এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে বন্দি হয় নিঃশব্দে। শিশুকাল থেকে তাকে শেখানো হয় সোজা হয়ে হাঁটতে নেই, প্রতিবাদ করতে নেই, জোরে কথা বলতে নেই, স্বাধীনতা চাইতে নেই – এভাবে তার মানসিক গঠনকে করে তোলা হয় ভঙ্গুর, অস্থির, আত্মবিশ্বাসহীন, ভীরু। এর পরিণাম ও হয়ে ওঠে অনেকক্ষেত্রে করুণ।
অনেক মেয়ে শিশু পরিবারে একান্ত প্রিয়জন যেমন দুলাভাই, ফুফা, খালু বা গৃহশিক্ষক কর্তৃক শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়েও ভয়ে কাউকে বলতে পারে না। পরিণত বয়সের নারীদের উপর এক গবেষণায় জানা যায়, ‘পাঁচজন নারীর মধ্যে কমপক্ষে একজন শিশুকালে এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন’।
আমার কৈশোরকালের এক বন্ধু গৃহশিক্ষক কতৃক শারীরিক নিপীড়নের শিকার হয়ে অভিভাবককে জানালে অল্প বয়সে বিয়ে এবং প্রথম সন্তানের জন্মের সময় অকালে তার মৃত্যু। ইদানিংকালে কিশোরীদের উপর ইভ টিজিং এর যে আগ্রাসী আচরণ এবং এ কারণে আত্মহননের পেছনে মূখ্য কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে বাঙালি পরিবারের মেয়েদের মৌনসংস্কৃতিজনিত অপরাধবোধ।
কৈশোরকাল যেন নারীর বন্দিত্বের সূচনাকাল। বয়সের এ পর্বে নারী ছাড়া আর আর সব প্রাণীই বোধহয় বেশি স্বাধীনতা পায়। পিতৃতন্ত্রের সতর্ক দৃষ্টি, অনুশাসন ইত্যাদি কারণে তাকে উপহার দেয় গভীর হতাশাগ্রস্ত হীনমন্যতা। আমার কাছে লেখা এক কিশোরী ছাত্রীর সুদীর্ঘ চিঠির প্রতিটি ছত্রে অনুভব করেছি, তার অবরুদ্ধ জীবনের গভীর দীর্ঘশ্বাস। অতঃপর মানসিকভাবে এক অর্ধভঙ্গুর ব্যক্তিত্বে শুরু হয় নারীর বিবাহিত জীবন।
বিয়ের ক্ষেত্রে এখনো হাজারো মেয়ের সম্মতি নেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেন না অনেক অভিভাবক। এভাবে তার সব ইচ্ছে বা অনিচ্ছের জলাঞ্জলি দিয়ে শুরু হয় বিবাহিত জীবন যেখানে তার মেধা, মনন ও সৃজনশীল শক্তি এক অদৃশ্য শেকলে বন্দি। বাল্যবিবাহ এখনো অভিশাপ হয়ে আছে, একটা সময়ে এটি ছিল নারীর ভাগ্য। বাংলা সাহিত্যে প্রথম আত্মজীবনী লেখক রাসসুন্দরী লেখেন-‘পিঞ্জরেতে পাখি বন্দি, জালে বন্দি শীল’ অথবা গভীর আক্ষেপে ‘আমার নারীকূলে কেন জন্ম হইয়াছিল, আমার জীবনে ধিক’।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বিয়ে নারীর জন্য এক প্রতিষ্ঠিত গৌরবের বিষয়। কনে সম্প্রদান শেষে অভিভাবক বলেন এটাই তোমার আসল ঠিকানা। যেমন আমার বিয়ের পরে মা বলেছিলেন ‘ দোয়া করি শ্বশুর বাড়ি থেকেই যেন তোমার কবরে যেতে হয়’। গেঁথে গেল ভেতরে। অতএব! সব মেনে নিয়ে মনে নিয়ে জীবন শুরু। অনেক মেয়ে ভাবে বিয়ের পরেই তো স্বাধীন জীবন। আসলে এটাই তাঁর বন্দিত্বের শুরু। প্রতিবাদী হলে ‘মুখরা রমণী’। আর ভালো মানে সংযম,সহিষ্ণুতা, ত্যাগ আর সংযম। তার মানবীয় সত্তার বিকাশ নয় বরং তার আত্মসমর্পণ সবার কাম্য।
নারীর যৌনজীবনও সমর্পিত ও সীমাবদ্ধ। নিজস্ব মতামত প্রকাশের সুযোগ বা আনন্দঘন মুহূর্তের প্রাপ্তি বড্ড ক্ষীণ। ভালোবাসা শুধুই প্রহেলিকা, অপরদিকে অতি যৌন আকাক্সক্ষাও নিন্দনীয়। আধুনিক সমাজেও অনেক নারী নিজের স্বকীয়তাকে আবিষ্কার করতে পারে না। এক অদৃশ্য নৈতিক অনুশাসনে বহুবছর এক ছাদের নিচে বসবাস করেও এক অস্পষ্টতায় ঘেরা দাম্পত্য জীবন – তাদের বিয়ে যেন কোন কালেই ‘ গধৎৎরধমব ড়ভ ঃড়ি সরহফং ’ হয়ে ওঠে না।
উত্তরাধিকার সূত্রে নারী সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও অনেক নারী বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পরে সম্পত্তির অধিকার নিয়ে তেমন প্রতিবাদী হয় না সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার কারণে। বিবাহিত জীবনে ও পরিত্যক্ত হলে বাবার বাড়িতে অবহেলায় বা অনাদরে। একসময়ে পৃথিবী থেকে বিদায়।
নারীর জীবনে শারীরিক কোন দুর্ঘটনা ঘটলে তাকে আড়াল করার চেষ্টা বা আইনের আশ্রয় নিলেও নানা হয়রানি। মুক্তিযুদ্ধে সম্ভ্রম হারানো মেয়েদের দুর্দশাতো নিজে দেখেছি। কেউ কেউ মুখ খুললেও পরিবার বা সমাজ তাদের তেমনভাবে গ্রহণ করেনি। আর মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতিও যেন এক প্রহসন।
বিদূষী নারী খনার বচনগুলো অসাধারণ প্রজ্ঞার কিন্তু এই কারণেই তাকে অকালে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
বলছিলাম নীরবতা নিয়ে। সংজ্ঞাগত ব্যাখ্যায় এটি কখনো কৌশল কখনো অভিমান কখনো প্রজ্ঞা বা প্রতিবাদের ভাষা। প্রাচ্যে বা পাশ্চাত্যে আজকাল মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু নারীর নীরবতা সারা জীবন চলতে থাকা এক রাহু চক্রের মতো। সারাজীবনের কষ্ট, যন্ত্রণা, বেদনা ঔদাসীন্য, অবহেলা ও মানসিক নির্যাতনের চাপকে বুকে চাপা দিয়ে একসময়ে জীবনের অবসান।
যদি কোন নারীর স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে বা পরনারীতে আসক্ত, প্রতিবাদী হলে তার জীবনে নেমে আসে মৃত্যুর বিভীষিকা বা অনেকে সন্তানসহ আত্মহত্যায়। হায়! নারীর জীবন।
অনেক হতভাগ্য নারী শুধু যেন অভিযোগ জানান বিধাতার কাছে। নীরদচন্দ্র চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনীতে তাঁর মায়ের কষ্টের জীবনের কথায় বলেন – ‘যে নারীরা প্রকাশ্যে নিজের কথা বলতে পারেনা তাঁদের অধিকাংশ ‘ংবহফ ঃযবরৎ ংবপৎবঃ ঃযড়ঁমযঃং ঃড় এড়ফ, ঃযব ঁহভধরষরহম ফরংঢ়বহংব ড়ভ ঔঁংঃরপব ’.
তবে বলতে হয়-অনেক নারীর মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা আছে, দায়িত্ব গ্রহণ ও পালনে অনীহা আছে – স্ববিরোধিতা আছে, আবেগের আতিশয্যে নিজেকে সমর্পিত করার অভ্যাস আছে, প্রয়োজনীয় তৎপরতায় ঘাটতি আছে, কুশলী ভূমিকা পালনে অপারগতা আছে- ইত্যাদি বিষয়গুলোকে আত্মসমালোচনা পূর্বক প্রকাশ ও বক্তব্য প্রদানে আরও সচেতন হতে হবে। নারী অধিকার নিয়ে যে সংগঠনগুলো কাজ করেন তাদের আরও সোচ্চার হতে হবে। আর নীরবতা নয়, নারীও মানুষ হিসেবে স্বমহিমায় জেগে উঠুক এই প্রত্যাশা।