হুমাইরা তাজরিন »
নাগরিক কোলাহলে ক্রমেহারিয়ে যাচ্ছে খেজুরগাছ, গাছি ও রস। এখন চোখেই পড়ে না হাড়ি ভর্তি খেজুর রস নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরি করার দৃশ্য। এরপরও শীত এলে খেজুর রস খাওয়ার অপেক্ষায় ব্যকুল হয়ে ওঠে নগরবাসী।
আনোয়ারা, সীতাকু-, মিরসরাই, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও বোয়ালখালী এলাকায় খেজুর রস বিক্রি করা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের তুলনায় খেজুর রস কমে গেছে। তাই কেউ রস পেলে তৈরি করে রসগোল্লা, পায়েস, ফিরনি ইত্যাদি বিভিন্ন মিষ্টি জাতীয় খাবার।
শৈশবের স্মৃতির উজ্জ্বল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে খেজুরের রস। শীতকাল এলেই মিলবে খেজুর রস,এই প্রত্যাশায় যেন সারাবছরই সবাই অপেক্ষায় থাকেন। শীতের পিঠার সাথে বাঙালিরা এই রস ও রসের গুড় খেতে ভালোবাসে। তবে অতীতের তুলনায় কম হলেও বাড়ি বাড়ি খেজুর রস বিক্রির রীতি একেবারে হারিয়ে যায়নি।এখনও চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে খেজুর রস ফেরি করা হচ্ছে।
নগরীর হালিশহর এলাকার বাসিন্দা মো. হান্নান বলেন, ‘এখন খেজুর রস পাওয়াই যায় না। এরপরও কয়েকদিন আগে সকাল সকাল খেজুর রস ফেরি করতে দেখি। কেজি ১০০ টাকা চাইলেও ৯০ টাকা দরে ৫ কেজি নিয়েছি। ভালো করে ছেঁকে চুলোয় জাল দিয়ে রস ভাঁপা পিঠা দিয়ে খেয়েছি।’
কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্ণনা অনুযায়ী,খেজুরের রস যতো সুস্বাদু এর সংগ্রহ ততো সহজ নয়। কেননা এ রস সংগ্রহের রয়েছে একটি দীর্ঘপ্রক্রিয়া।তাই দক্ষ অভিজ্ঞ গাছি ছাড়া যে কেউ এ রস সংগ্রহ করতে জানেন না।শুরুতে গাছিরাবাড়ি বাড়ি ঘুরে গাছ পর্যবেক্ষণ করেন। তারপর কোন কোন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করবেন তা নির্ধারণ করেন। শীতের শুরুতেই ধারালো কাচি দিয়ে খেজুর গাছের পুরোনো ডাল পালা ছেটে দেওয়া হয়। যে দিকে রস সংগ্রহ করা হবে সেদিকে ত্রিভুজের ন্যায় আকৃতি করে খাঁজ কাটা হয়। যাতে গাছে ভিতরকার সাদা অংশ দেখতে পাওয়া যায়। বাঁশের নলা সেই ত্রিভুজাকার খাঁজের নিচে যুক্ত করা হয়। যাতে রস গড়িয়ে নিচের অংশে বাঁধা মাটির হাঁড়িতে জমা হয়। সেই মাটির হাড়িকেও প্রস্তুত করা হয়।
বাইরের অংশে চুন দিয়ে কয়েকদিন রোদে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় মাটির তৈরি রস সংগ্রহের এসব হাড়ি। তারপর ভোর ৬টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে প্রতিদিন বা একদিন পর পর রস সংগ্রহ করা হয়। একটি গাছ থেকে প্রতিদিন ২ থেকে ৫ লিটার রস সংগ্রহ করা হয়।প্রতি লিটার বিক্রি হচ্ছে ৮০-১০০ টাকা দরে। প্রতি মৌসুমে এই রস থেকে ২৫ থেকে ৩০ কেজি গুড় তৈরি হয়। গুড়েরও রয়েছে বিভিন্ন প্রকারভেদ। যেমন ঝোলা গুড়, পাটালি গুড় , নলেন গুড়, ভেলি গুড়, বালুয়া গুড় ও মিছরি গুড়। এর মধ্যে পাটালি গুড়,হাজারি গুড় ও লালি গুড়ের জনপ্রিয়তা বেশি। বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০টাকা দরে। আঠালি গুড় প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০-২০০টাকা দরে।
কাঁচা খেজুরের রস খুবই সুস্বাদু। তাছাড়া এটি শারীরিক দুর্বলতা কাটাতে সহায়তা করে। জাল দিয়েই মূলত গুড় তেরি করা হয়।গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে। যা শরীরে হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়া রয়েছে প্রচুর খনিজ, প্রোটিন, ফ্যাট ও মিনারেল। আছে ১৫-২০% শর্করা।
মেডিসিন বিশেষজ্ঞ সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব বলেন,‘ বাঁদুড়ের মাধ্যমে ছড়ানো নিপা ভাইরাস হতে রক্ষা পেতে দুটি উপায় রয়েছে। যে কলসে রস সংগ্রহ করা হয় তার মুখে যদি নেট দিয়ে দেওয়া হয় তাহলে বাঁদুড় মুখ দিতে পারেনা।আরেকটি হলো রস একেবারে কাঁচা না খেয়ে সেটিকে ১০০ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ফুটিয়ে খেলে তাতে আর ভাইরাস থাকেনা।’
পূর্বে শীতকাল আসলেই বাড়ি বাড়ি খেজুর রস বিক্রির ধুম পড়ে যেতো। তবে দেশের যেসব এলাকায় খেজুর গাছের পরিমাণ কম সেসব এলাকায় এখন সেই দৃশ্য কচিৎ মেলে। তবে যশোর,মাদারীপুর,শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাগুড়া, চুয়াডাঙা ও ঝিনাইদহ জেলায় এসব দৃশ্য অপ্রতুল নয়। তবে আগে দেশের সর্বত্রই খেজুর গাছ,রস সংগ্রহের গাছি সংখ্যা ছিলো পর্যাপ্ত যার ফলে খেজুর রস সর্বস্তরের বাঙালির আবেগের ও ঐতিহ্যের বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে।তবে বর্তমানে দক্ষ গাছি, খেজুর গাছের অপ্রতুলতার কারণে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে খেজুর রসের যোগান। যোগান কম থাকায় প্রতি বছর হু হু বাড়ছে খেজুর রস ও গুড়ের দাম।
মোহসেন মিয়া নামের একজন গাছি জানান,‘ প্রথমত গাছ আগের মতো নাই। যা আছে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোর বেশিরভাগই মরে যায়। তারউপর সব এলাকায় দক্ষ অভিজ্ঞ গাছি নেই।দূরে গিয়ে রসের তদারকিও সম্ভবও হয়না। যে পরিমাণ শ্রম হয় গাছের মালিকের অংশ বুঝিয়ে দেওয়ার পর বিশেষ কিছু থাকেনা।’
এ সংকট নিয়ে নগরীর ডবলমুরিংস্থ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মেট্রোপলিটন কৃষি র্কমর্কতা কামরুম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘রস সংগ্রহ করার জন্য খেজুর গাছে চাষর কেউ করেনা।আমাদেরও সেরকম কোনো কর্মসূচি নেই। তবে উন্নত মানের খেজুর উৎপাদন করতে কেউ কেউ খেজুর গাছের চাষ করে থাকে। এছাড়া বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ায় আমাদের জুন মাসে খেজুর গাছ রোপণের একটি কর্মসূচি থাকে , যেহেতু খেজুর গাছ বজ্রপাত থেকে রক্ষা করে। তবে গুড় চাষিরা যদি ২৫-৩০ জনের মতো একটি দল নিয়ে ৫-৬ একর জমির মধ্যে খেজুর রস উৎপাদনের গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয় আমরা তাদের সহযোগিতা করবো।’