হাফেজ মুহাম্মদ আনিসুজ্জমান »
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই সমস্ত প্রশংসার মৌলিক হকদার, যিনি তাঁর গোটা সৃষ্টিজগত’র উত্থান-পতন, সৃষ্টি ও বিনাশ-সামগ্রিক অবস্থার নিয়ন্তা। তাঁর পবিত্রতা, যিনি সেরা সৃষ্টি মানবজাতির জন্য পবিত্র বস্তু হালাল এবং অপবিত্র বস্তু হারাম করেছেন, তাঁর অনুগত বান্দাকে হারাম থেকে বারণ করেন। তাঁর কৃতজ্ঞতা জানাই, যিনি ‘আশরাফুল মাখলুকাত’র মর্যাদা দেবার জন্য মানুষকে তাঁর প্রতি উৎসর্গিত হতে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে উম্মতের নিকট নিজ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন।
আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই। প্রভুত্ব, উপাসনা তাঁরই জন্য তিনি ¯্রষ্টা, তিনি পালনকর্তা। সৃষ্টি ধ্বংস-রক্ষা তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। তিনি ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই। আমাদের সুপথে আহ্বানকারী, পারের কা-ারী আরবের নবী, করুণার ছবি, সায়্যিদুনা হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আল্লাহ্র সৃষ্টি, তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রাসূল। পবিত্র কুরআন যাঁর প্রতি অবতীর্ণ, যাঁর বাণী পবিত্র কুরআনেরই ব্যাখ্যা বিবরণ।
সমন্বিত মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর আল্লাহ ও রাসূলের বহুবিধ আদেশ-নিষেধ কুরআন-হাদীসে বর্ণিত। কিছু ব্যক্তি জীবনে, কিছু পারিবারিক, কিছু সামাজিক ও দেশ-দশের প্রতি করণীয়। নামায- রোযা, হজ্ব-যাকাত এগুলো যেমন ফরয, তেমনি সমাজ ও দেশের প্রতি অনেক নির্দেশনা একজন মুসলমানের জীবনে বর্তায়। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণে কুরআন-হাদীসে ইবাদত-বন্দেগীর মত আর একটি শব্দ ইসলামী পরিভাষায় ব্যাপক আলোচিত ও শ্রুত হয়। সেটি হল ‘জিহাদ’। শব্দটির অর্থ, আবেদন আপেক্ষিক। এর সঠিক প্রায়োগিক যথার্থতাও ভিন্ন ভিন্ন। এর উল্লেখ কুরআন-সুন্নাহয় আছে বলেই তা অস্বীকারও করা যায় না, তেমনি প্রেক্ষাপট বিবেচনা ছাড়া এটার যততত্র ব্যবহারও সঠিক নয়। হাদীস শরীফ ও ফিকহ্ (ইসলামী আইন ও বিধি-বিধান সংক্রান্ত) শাস্ত্রে স্বতন্ত্র কিতাব বা অধ্যায় শিরোনামে এটি শাস্ত্রীয় পরিভাষা। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে অর্থ-আবেদনও হয় ভিন্ন ভিন্ন। ‘বাযলুল জুহুদ’-এর আক্ষরিক অর্থ। এর অর্থ প্রচেষ্টা বা শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করা। সামর্থ্য যেমন সকলের সর্বক্ষেত্রে সম-পর্যায়ের নয়, তাই শাস্ত্রীয় জিহাদ ও সবার ক্ষেত্রে সমপ্রযোজ্য নয়। অস্ত্রপ্রয়োগ সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীকে প্রকাশ্য অস্ত্র ধারণ ও বহনের অনুমতি রাষ্ট্র দিয়ে থাকে, যা সাধারণ নাগরিকের জন্য দেয়া হয় না। তাই, এটি সাধারণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এ প্রচেষ্টাকে ধ্বংসে আত্মাহুতি বলা যায়। আবার পবিত্র হাদীস শরীফে জিহাদ জারী থাকার কথাও রয়েছে। বলা যায়, এটি পরিস্থিতি ও সামর্থ্যসাপেক্ষ। যদি না হয়, তবে মক্কী জীবনের ৫৩ বছরের সময়ে রাসূলুল্লাহ এ ব্যাপারে কোন অনুমতি দিলেন না কেন? নবুওয়ত’র উদাত্ত ঘোষণা আসে তাঁর পার্থিব সময়ের চল্লিশ বছর পূর্ণ হলে, এরপরের তেইশ বছরের অধিকাংশ সময় (অর্থাৎ তের বছর) পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। সরাসরি প্রত্যক্ষ সশস্ত্র মোকাবেলার অনুমতি আসে হিজরতেরও পরবর্তী বছরে। দেখা যায়, চাহিদা ও পরিস্থিতির সমন্বয় ছাড়া নবী হওয়া সত্ত্বেও তিনি যুদ্ধের অনুমতি দেন নি। আবার এটাও বলা যাবে না যে জিহাদ মানসুখ বা রহিত হয়েছে। অনুকূল পরিস্থিতি পরিবেশ সাপেক্ষে এটা অপরিহার্যও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, জিহাদ ও সন্ত্রাসবাদ এক নয়। মানুষকে জিম্মি করে রাখাও জিহাদ নয়।
প্রেক্ষাপট, পরিস্থিতি ও সামর্থ্য অনুযায়ী এর হুকুম ভিন্ন হয়। একটি ক্ষেত্রে মুসলমানদের সবার জন্য সামগ্রিক পরিস্থিতিতে একটি জিহাদ ফরয তা হচ্ছে, আল্লাহ্ ও রাসূলের সন্তুষ্টির জন্য নফস’র বিরুদ্ধে জিহাদ। একটা সময় বিশেষ একটি স্লোগান বেশ শোনা যেত। ‘জিহাদ চাই, জিহাদ চাই, জিহাদ করে বাঁচতে চাই- পূর্বোক্ত বাক্যের রেশ ধরে বলা যায়, তাও অর্থভেদে সঠিক। যেমন নফ্স ও রিপুর বিরুদ্ধে জিহাদ করে জাহান্নামের আগুন থেকে আমরা নিশ্চয় বাঁচতে চাই। পবিত্র কুরআনে বলা আছে, ‘মুমিনগণ, নিজকে ও পরিবারকে দোযখের আগুন হতে বাঁচাও।’। (সুরা তাহরীম : ৬) জিহাদ মানে শক্তি সামর্থ্য ব্যয় করা অর্থে এর প্রযোজ্যতা সর্বকালে, সর্বত্র। এ প্রসঙ্গে দু’ একটি আয়াতের নির্দেশনা উদ্ধৃত করা যায়। যা আজ খুৎবার প্রতিপাদ্য।
মহান আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ্কে ভয় করো, আর তাঁর প্রতি ওয়াসিলা (তথা মাধ্যম) অন্বেষণ করো এবং তাঁর রাস্তায় জিহাদ করো, যাতে সফলতা অর্জন করতে পার’। সুরা মায়েদাহ্ :৩৫) এ আয়াতে ওয়াসিলা ও অন্বেষা দুটি শব্দ আছে। ওয়াসিলা দ্বারা মাধ্যম বুঝায়, আর অন্বেষণ বলতে বুঝায় প্রচেষ্টা। আল্লাহ্র সন্তুষ্টি অর্জন পূর্বক মানবজীবনের চূড়ান্ত সাফল্য অর্জনে অস্ত্রের চেয়ে নফস’র মোকাবেলায় প্রাণান্ত প্রচেষ্টাই সঠিক জিহাদ। এখানে ওয়াসিলা একাধিক অর্থ রাখে। মুফাসসিরগণের অনেকে ওয়াসিলার অর্থ নৈকট্য বলেছেন, তাও যদি হয়, তবে প্রচেষ্টাটা সাংঘর্ষিক বা অস্ত্রদ্বারা হয় না, নফসের বিরুদ্ধে জিহাদ বুঝানো হয়েছে।
আর একটি আয়াতে রয়েছে, ‘তোমরা আল্লাহ্র পথে কষ্ট করো, যেমন কষ্ট করা সমীচীন। তিনি তোমাদেরকে নির্বাচিত করেছেন এবং দ্বীন’র ব্যাপারে তোমাদের ওপর তিনি দুঃসহ কোন বিধান চাপাননি’। (২২:৭৮) কোন লক্ষ্য অর্জনের জন্য পূর্ণশক্তি নিয়োগ করা, উদ্দেশ্য পূরণের জন্য কষ্ট স্বীকার’র নামই জিহাদ। হযরত ইবনে আব্বাস (রাদ্বি.) বলেন, পূর্ণশক্তি ব্যয় করাই হক্কুল জিহাদ। অনেক তাফসীরকারকের মতে, এখানে ‘জিহাদ’ বলতে নিজ প্রবৃত্তি ও অন্যায় কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে জিহাদ বা সংগ্রাম করাই বুঝানো হয়েছে। যেমন বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে, একবার সাহাবায়ে কেরামের একটি দল কাফিরদের বিরুদ্ধে অভিযান শেষে ফিরে এলে আল্লাহ্র রাসূল ইরশাদ ফরমান, তোমরা ছোট জিহাদ থেকে বড় জিহাদের দিকে ফিরে এলে। এ মর্মে একটি হাদীস জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ্ (রাদ্বি.) হতে ইমাম বগভীও বর্ণনা করেছেন। দৃশ্যমান শত্রুর সাথে মোকাবেলা করার চেয়ে অদৃশ্য শক্তির মোকাবেলা করা অনেক বেশি দুরূহ ও কঠিন কাজ। শয়তানের শত্রুতার কথা পবিত্র কুরআনেই ঘোষিত, একাধিক স্থানে কথাটি ঘোষণা করা হয়েছে। প্রতিটি মুসলমানের একেকটি জিহাদ রয়েছে। যার মধ্যে তার মুক্তি ও কল্যাণ রয়েছে। শক্তিমান ও ধনবান মুসলমানের জন্য জানÑমাল দিয়ে দ্বীনের সেবা করাই জিহাদ। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘হে নবী আপনি কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করুন, আর তাদের প্রতি কঠোর হন’। কাফির বা মুসলমানের বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে জিহাদের উদাহরণ নবী করিম ও সাহাবায়ে কেরামের প্রত্যক্ষ ও সশস্ত্র সংগ্রাম সেই প্রেক্ষাপটে সেটাই ছিল অপরিহার্য। তবে মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার মর্মার্থ হল মৌখিক জিহাদ। তাদেরকে ইসলামের সত্যতা, স্বচ্ছতা উপলব্ধি করতে আহ্বান করা, যাতে তারা যেন ইসলামের আদর্শে নিষ্ঠাবান হতে পারে। কুরতুবী, মযহারী গ্রন্থের বরাতে বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে এ মর্মার্থ বর্ণিত হয়েছে।
অনেকে আছেন আর্থিক স্বচ্ছল, কিন্তু দৈহিক দুর্বল। তাদের জিহাদ হল ইবাদত, সদকা আর নফসের সাথে লড়াই করা। শুনতে সহজ হলেও কাজ কিন্তু কঠিন। আমরা অন্যজনকে বহু সদুপদেশ দিলেও ক’জন পারি তা নিজ জীবনে যথাযথ পালন করতে? সুপ্তির নিদ্রা ছেড়ে ফজরের সময় ক’জন আমরা মসজিদে গিয়ে জামাতে শামিল হই? তা পালন করতে হলে অবশ্যই নফস বা কুপ্রবৃত্তির সাথে রীতিমত যুদ্ধ করতে হবে। নফস’র বিরুদ্ধে জয়ী হতে পারলেই আল্লাহ্ ও রাসূল খুশি হবেন। আদম-হাওয়াকে ও ইবলিসকে বেহেশত হতে পৃথিবীতে অবতরণের নির্দেশ দিতে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তোমরা সবাই একে অপরের শত্রু হয়ে নেমে পড়ো’। শয়তান শুধু আদম-হাওয়া (আ.)র শত্রু নয়, বরং মহাপ্রলয় পর্যন্ত আগত সকল আদম সন্তানের জন্য সে আত্মঘোষিত প্রকাশ্য শত্রু। তাই, এ অদৃশ্য মহাশক্তিধর শত্রুর সাথে মোকাবেলা তথা জিহাদ করা বড় জিহাদ তো বটেই। এ অমোঘ সত্য কে অস্বীকার করবে?
শয়তান একদল বান্দার ব্যাপারে নিজের অক্ষমতার কথা জানিয়ে দিয়েছে। সে আদম সন্তানদের বিপথগামী করার শপথ করে বলেছে, ‘হে পালনকর্তা আপনার ইযযতের কসম, আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করবো, তবে যাঁরা আপনার খাঁটি বান্দা, তাঁদের ছাড়া।’ (৩৯:৮২-৮৩) তাঁদের ছায়ায় যদি আশ্রয় থাকে, তবে এ শত্রুর মোকাবেলা করা যেতে পারে, জয়ী হওয়া যাবে নফসের বিরুদ্ধে জিহাদে।
লেখক : আরবী প্রভাষক,
জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলীয়া মাদ্রাসা।
খতিব : হযরত খাজা গরীব উল্লাহ শাহ (র.) মাজার জামে মসজিদ।