নিজস্ব প্রতিবেদক »
পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের চট্টগ্রাম গুডস পোর্ট ইয়ার্ডে (সিজিপিওয়াই) ডিজেল ভর্তি একটি ওয়াগন ট্রেনের দুইটি তেল ভর্তি বগি উল্টে গেছে। এতে নগরের এসহাক ডিপো এলাকা থেকে জরিনা-মফজল সিটি করপোরেশন কলেজের পাশের ড্রেনে ভেসে মহেশখালে ছড়িয়ে পড়েছে তেল। এ তেল কুড়াতে নেমে যায় শিশু কিশোর থেকে বৃদ্ধরাও। তবে তেলের তীব্র গন্ধে মানুষের নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এছাড়া এ তেল খালে ভেসে নদীতে ছড়িয়ে পরিবেশের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে এ ঘটনা ঘটলেও গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ৩ টায় এ ট্রেনটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয় রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, পদ্মা-মেঘনা ও যমুনা থেকে তেল ভর্তি করে সিজিপিওয়াইতে প্রবেশ করছিল ওই ট্রেনটি। ৮০৯ আপ হয়ে ঢাকায় যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ট্রেনটি সিজিপিওয়াইতে প্রবেশের ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মাথায় লাইনচ্যুত হয়ে উল্টে যায়। একটি বগিতে ৩৪ হাজার ৬১০ লিটার করে দুইটি বগিতে মোট ৬৯ হাজার ২২০ লিটার তেল ছিলো।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টার দিকে ঘটনাস্থলে সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো এলাকাজুড়ে ডিজেলের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়েছে। তেলবাহী বগি দুইটি উদ্ধারে কাজ করছিলো রেলওয়ে। মানুষ ড্রেনে ও খালে নেমে বালতি ও বোতলে করে তুলে নিচ্ছিলো তেল। তাদের কেউ কেউ তেল তুলে সাথে সাথে বিক্রি করছে ৬০ টাকায়। মোহাম্মদ সিদ্দিক নামে এক ব্যক্তি খাল থেকে তুলেছে ১০৯ লিটার তেল। এরকম অনেকেই সাধ্যমতো তেল তুলে নিচ্ছিলো। নদীর কাছাকাছি গিয়ে দেখা গেছে স্লুইচ গেট বন্ধ রয়েছে। নদীতে তেল ভাসতে দেখা গেলেও তা খুবই সামান্যই বলা যায়।
খাল থেকে তেল সংগ্রহ করতে আসা মোহাম্মদ সিদ্দিক বলেন, ‘বগি দুইটা থেকে বেশিরভাগ তেল পড়ে গেছে। এখানে অনেকে আসছে। তেল তো আর পানির সাথে মিশছে না। পানির উপরে কালো কালো হয়ে ভাসছে। সহজভাবে তুলে নেওয়া যায়। আমি এমনিতে রিকশা চালাই। আজকে রিকশা নিয়ে বের হয়নি। তেল তুলে বিক্রি করছি। এখন পর্যন্ত ১০৯ লিটারের মতো পেয়েছি।’
ঘটনাস্থলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রায় ৭০ হাজার লিটার তেল ছিল বগি দুইটিতে। যা ড্রেন হয়ে আশপাশের খালে ছড়িয়ে যাওয়ার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। বাঁশ, কাঠ দিয়ে আমরা তেল যেন না পড়ে সেই ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তেমন কাজ হচ্ছে না।’
কি পরিমাণ তেল পড়েছে জানতে চাইলে বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক আবিদুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, সেহেতু এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর সবকিছু জানা যাবে। যতটুকু তেল ছড়িয়েছে বলা হচ্ছে, ততটুকু তেল পড়েনি। ’
ডিজেল ঠেকাতে ড্রেন বন্ধ না করার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন ঘটনাস্থলে এসেছি তখন ওয়াগনের মুখ বন্ধ করে দিয়েছি। অন্যান্য উৎসগুলোও যতটুকু সম্ভব বন্ধ রাখার চেষ্টা করেছি।’
হুমকিতে জীববৈচিত্র্য
ডিজেল আশপাশে ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য বিপর্যয়ের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা। স্থানীয়দের মতে, ওই খাল এবং আশপাশের এলাকায় মশা ও বিভিন্ন কীটপতঙ্গ মারা গেছে। ঘটনাস্থলের আশপাশে ও ইসহাক ডিপো এলাকায় ছড়িয়েছে ডিজেলের তীব্র গন্ধ।
হালিশহরের বাসিন্দা লিমন হায়দার বলেন, ‘ঘটনাটি ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেল খালের মুখে চলে যায়। এরপর রাতে আর খেয়াল করিনি। সকাল গিয়ে দেখি খালে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রেন থেকে সব তেলই তো মনে হচ্ছে পড়ে গেছে। খালে মশা-মাছিসহ নানা কীটপতঙ্গ মরে গেছে। আশপাশের গাছপালাও ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও হালদা নদী গবেষক মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, তেল যদি খালের মাধ্যমে নদীতে ছড়িয়ে যায় তাহলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কা থাকবে। কেননা খাল থেকে তেল তুলে নেওয়ার যে সুযোগ আছে তা নদী থেকে সম্পূর্ণ অসম্ভব। এখন রেলওয়ে ও সংশ্লিষ্টরা যদি খাল ব্লক করতে সক্ষম হয়, তাহলে তেমন সমস্যা হবে না। হঠাৎ ঘটে যাওয়ার দুর্ঘটনার ক্ষতি সাময়িকভাবে হলেও পরে তা রিকভার করা যাবে। কিন্তু নদীতে ছড়ালে তা মাছ ও জলজ প্রাণীর বড় ধরনের ক্ষতি হবে।’
এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এ সময় তারা মহেশখালসহ বিভিন্ন স্পট থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষার জন্য নিয়ে যায়।
এ প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মো. মনির বলেন, ‘খালটি সংলগ্ন নদী ও বিভিন্ন খালে তেল ছড়িয়ে পড়ার আলামত দেখা গেছে। খাল সংলগ্ন স্লুইচ গেট বন্ধ থাকায় তেল তুলনামূলক কম ছড়িয়েছে। তা না হলে আরো বেশি ছড়াতো। তবে কি পরিমাণে তেল ছড়িয়েছে এবং এর প্রভাব কতটুকু হবে তা ল্যাব টেস্টের পর অনুমান যাবে।’