ড. আনোয়ারা আলম »
কালের চক্রে হারিয়ে যায় একেকটি বছর। যদিও প্রতিটি বছর কাটে বলা যায় গতানুগতিক ভাবে। কিন্তু এরপরেও মনের মাঝে প্রত্যাশা থাকে হয়তো বা কেটে যাবে সংকটের সময়। জেগে উঠবো নতুন আশায়। তবে হিসেবও মিলাই আমরা। কি পেলাম আর না পেলাম। তবে নতুন বছরে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। সাত জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে নির্বাচন। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী আমেজে দেশের জনগণ। চলছে প্রচার ও প্রচারণা। যদিও বড়ো দল হিসেবে বিএনপি অংশ নিচ্ছেনা। কিন্তু থেমেও নেই তারা। প্রতিবারের মতো চালাচ্ছে সহিংস আচরণ। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে দেশের পরিস্থিতিকে অশান্ত করার লক্ষ্যে রেলে বাসে আগুন লাগানো ছাড়াও নানাভাবে এক হীন চক্রান্তে জড়িত এই দল; যা কোনভাবেই কাম্য নয়। সুতরাং একটা আশংকা থেকেই যাচ্ছে।
কেমন ছিল পুরো বিশ্ব। না। কোনভাবেই ভালো না। ভেবেছিলাম এক মহামারির শিক্ষায় পুরো মানবজাতি শুদ্ধ হবে। শান্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। পরিবর্তে দেখি উন্নত বিশ্বের আগ্রাসী আচরণে মানবতার চরম ধস নেমেছে। প্রথমে আমেরিকার মদদে ইউক্রেন এর সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ। নেমে এলো বড়ো বিপর্যয় তথা বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা। যার করাল থাবায় শুধু বাংলাদেশ নয় পুরো বিশ্বে আর্থিক বিপর্যয়। অর্থনৈতিক বাজারে চরম অস্থিরতা। আমাদের দেশেও এর প্রভাবে চরম সংকটে জনগণ। সাথে যুক্ত হয়েছে মুনাফা লোভী ব্যবসায়ীরা। এদের সিন্ডিকেটের সাথে ভারত কর্তৃক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্রের ক্ষেত্রে আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, একসময়ে বলা হতো ভাতের বদলে আলু খান কিন্তু এবারেই দেখতে হলো চালের চাইতে আলুর দাম বেশি। এতে দেশে বেড়েছে ধনী গরীবের বৈষম্য। অনেককে দু’বেলায় ভাত খেতে হয়েছে শুধু মাত্র লবণ দিয়ে। এর চাইতে দুঃখজনক আর কি হতে পারে। তবে দুঃখের বিষয় এতোটা বছরেও ভোক্তাদের একটা শক্ত সাংগঠনিক দল গড়ে ওঠেনি।
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান ক্রমশ ভালোর দিকে গেলে বা রিজার্ভ একটানা তিনি বছর শক্ত অবস্থানে থাকলেও এবারে ধাক্কা খেয়েছে আর ডলারের দাম বেড়েছে আশংকাজনকভাবে। বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ও বেড়েছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি আরও সংকটে পড়েছে আরও একটি কারণে সেটি হলো প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণ। বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। আমরা অসহায়ের মতো দেখছি প্রতিদিন বিপন্ন মানবতার এক অন্ধকার চিত্র। লাখো শিশুর রক্তাক্ত লাশের স্তুপ। অথচ এই আমেরিকাই গণতন্ত্রের বড়ো বড়ো বুলি আওড়িয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
২০২৩ সালে করোনা পরবর্তী সময়ে আরও ভয়াবহ অবস্থা হিসেবে এসেছে ডেঙ্গু। বলা যায় আরও একটা মহামারির মতো। সবচেয়ে বেদনার বিষয় হলো করোনার মতো মহামারিকে যেভাবে সামাল দিয়েছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ, সেভাবে কিন্তু ডেঙ্গুকে তেমন আয়ত্বে আনা যায়নি। বেশি আক্রান্ত হয়েছে অল্পবয়সী জনগণ ও শিশুরা। মৃত্যু হয়েছে প্রায় এক হাজার ছয়শত নিরানব্বই জনের। যার মধ্যে শিশুর সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা সিটি কর্পোরেশন কিছুতেই এড়াতে পারেনা কোন নগরের মেয়রকে দেখিনি, ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে।
তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩তম পারমানবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। রেল যোগাযোগের এক নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে। ঢাকায় প্রথম মেট্রোরেলের পুরোটা সম্পন্ন হয়েছে। এখন ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে শহরে পরিণত হয়েছে। ঢাকা কক্সবাজার রেলওয়ে চালু যেমন তেমনি পদ্মাসেতুর দুই পাড়ে রেলওয়ে সংযোগ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
আকাশ পথেও তৃতীয় টার্মিনালের সফট ওপেনিং করা হয়েছে অক্টোবর মাসে। সমুদ্র বন্দরকে ঘিরেও আশার আলো। পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল পরিচালনায় সৌদি আরবের একটি কোম্পানি যুক্ত হয়েছে। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল উদ্বোধন ও একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যদিও কালুরঘাট ব্রিজ সংস্কার করাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ বলে নগর পরিকল্পনাবিদদের মতামত। এটিও হবে এই প্রত্যাশা আমাদের।
একজন নারী জান্নাতুল ফেরদৌসকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে আসা এই নারী এখন একজন অ্যাক্টিভিস্ট। যিনি চলচ্চিত্র নির্মাতা লেখক ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক প্রচারক হয়ে উঠেন। নারীদের অর্জন আরও অনেক হয়েছে ২০২৩ সালে যা একজন নারী হিসেবে প্রশংসা করতে পারি।
তবে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা কমেনি। দুঃজনক হলেও সত্যি পারস্পরিক সম্পর্কে বন্ধন কমেছে। আমরা অতি বেশি আত্মকেন্দ্রিক হচ্ছি দিনে দিনে। বৈবাহিক বন্ধনে চরম চির ধরেছে। নারী পুরুষ সমান তালে এগিয়ে। বহুগামিতা বেড়েছে। তাই সহিংস আচরণ নারী ও পুরুষের মধ্যে। পরকীয়ার কারণে দু’পক্ষেই খুন বা আত্মহত্যা বেড়েছে।
তবে ২০২৩ সালের মতো এতো আত্মহত্যার সংখ্যা বোধহয় আগে পরিলক্ষিত হয়নি। এক্ষেত্রে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক কারণই বেশি মনে হয়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে বটে, তবে কোথায় যেন একটা শূন্যতা। কোথায় যেন একটা বিভাজন। মানুষে মানুষ যে গভীর বন্ধন তা যেন সামাজিক মিডিয়াতেই সীমাবদ্ধ। একই সাথে ধর্মান্ধতাও বেড়েছে এবং ধর্মকেন্দ্রিক সহিংসতাও। যা আমরা পরাধীন দেশেও কল্পনা করতে পারিনি।
এরপরেও আশা করছি আগামী বছর আমরা যেন মনুষ্যত্ববোধের বিকাশে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। যে মন এখন ধীরে অনুভূতিশূন্য হয়ে উঠেছে, যে মন এখন গভীর আবেগে ও ভালোবাসায় একে অপরের হাত ধরিনা, তাতে যেন ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। আমরা যেন মানবিক হয়ে উঠি। সবার জন্য নতুন ইংরেজি বছরের শুভেচ্ছা।