নিজস্ব প্রতিবেদক»
‘নজরুলের কবিতায় পুঁজিবাদের সমালোচনা আছে। যে পুঁজিবাদের শোষণপ্রবণতার কথা কার্ল মার্কস বলে গেছেন। তিনি শোষিত শ্রেণির পক্ষে কথা বলেছেন। বিশ্বের শ্রমিকেরা উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটা পাচ্ছে না। শ্রমিকেরা উৎপাদন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পেলে আলাদা করে স্বাধীনতার দরকার নেই। তাই তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে মানুষের প্রতিবাদী সত্তাকে জাগ্রত করতে চেয়েছেন।’ ৯ জানুয়ারি বিকেল ৪টায় প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াসা ক্যাম্পাসের কেন্দ্রীয় মিলনায়তনে আয়োজিত ‘পয়েট নজরুল ইন অ্যা গ্লোবাল পারসপেকটিভ’ শীর্ষক আন্তর্জাতিক সেমিনারে মাসাচ্যুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক ড. উইনসটন ল্যাংলি এসব কথা বলেন।
ল্যাংলি রচিত ‘দ্যা আইডিয়া অব পারমানেন্ট রেভ্যুলেশন ইন দ্যা রেবেল’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘নজরুল সহানুভূতিশীল হওয়ার কথা বলেছেন। তিনি একজন সহানুভূতিশীল মানুষ হয়ে পৃথিবীর সমস্ত শোষিত মানুষের কবিতে পরিণত হয়েছেন। এবং যখন কোনো মানুষ সহানুভূতিশীল হয় তখন তিনি বঞ্চিত-শোষিত সকলের অনুভূতিকে ধারণ করতে পারেন এবং এটিই তাঁকে বিপ্লবী করে তোলে। তাঁর মধ্যে চিরস্থায়ী বিদ্রোহ চেতনা বিকশিত এবং বদ্ধমূল হয়। এভাবেই রচিত হয় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এবং এভাবেই জন্ম হয় একজন বিদ্রোহী কবির।’
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। সেমিনারটি উদ্বোধন করেন কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম। বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সভাপতি সাদাত জামান খানের সভাপতিত্বে সেমিনারে বক্তব্য রাখেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্নার্ড কলেজের শিক্ষক ও গবেষক ড. রাচ্যাল ম্যাকডারমোট। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শান্তনু দাশ।
ড. রাচ্যাল ম্যাকডারমোট তাঁর ‘দ্যা ফেস অব মিচফরচুন : এক্সপ্লোরিং দ্যা পিকটোরিয়াল ট্র্যাডিশন অব অ্যা ডিজিসড হিরো’ শীর্ষক নজরুল বিষয়ক আলোচনাকে ৩টি ভাগে বিভক্ত করেন। যেখানে তিনি নজরুলের জীবনকে বিভিন্ন চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন। নজরুলের অসুস্থতার উন্মেষের বীজ যে তাঁর নিজের শরীরেই বহমান ছিল, আলোচক তা বহু তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে, নজরুলের একটি ছবিতে দুটি চোখের দৃষ্টির অভিমুখ দুদিকে। যেটি মারাত্মক ¯œায়ুরোগের লক্ষণ। যা তিনি নজরুল সম্পর্কে জানতে গিয়ে লক্ষ করেন। বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাত নজরুলকে তিলে তিলে অসুস্থতার দিকে ধাবিত করে। যার মধ্যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রাপ্ত আঘাতকে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘১৯৮৯ সালে আমি যখন নজরুলের ছবি দেখেছিলাম তা আমাকে নিঃসন্দেহে সংবেদনশীল করেছে। নজরুলের প্রতি আমার সহানুভূতি আরও গভীর করেছে এবং আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে বহু বছর ধরে সেই অতল গহ্বরে ডুব দেওয়ার জন্য। মনের সর্বমূলীয় ক্ষতি কেমন হতে পারে তা কল্পনা করার জন্য। এবং যখন আমি তা উপলব্ধি করলাম আমি কৃতজ্ঞতার সাথে ফিরলাম।’
অধ্যাপক অনুপন সেন বলেন, ‘ব্রিটিশেরা উপমহাদেশের অংশ হয়নি। আমাদের সম্পদ নিয়ে গেছে। আমাদের সাথে একাত্ম হবার চেষ্টা করেনি। তবে ব্রিটিশদের আগে যারা এখানে এসেছে তারা সবাই আমাদের অংশ হয়েছে। অবশ্যই আমরা স্বীকার করি, ব্রিটিশেরা আমাদের মনের ভেতরে অনেক নতুন নতুন প্রগতির ধারণা গেঁথে দিয়ে গেছে। এখানে ক্যাপিটালিজম ছিল কিন্তু ন্যাশনালিজম হয়নি। বরং আমরা বুঝতে পারছিলাম আমরা গরিব থেকে আরও গরিব হয়ে যাচ্ছি।’
অধ্যাপক মোহীত উল আলম বলেন, ‘নজরুলের জীবনটা একটা রক্তাক্ত জীবন। কমরেড মোজফ্ফর আহমদ দেখেন, সারারাত জেগে নজরুল কবিতা লেখেন। তাও কলমে নয়, পেনসিলে। সকালে নজরুল তাঁকে দেখিয়ে বলেন ‘এই কবিতাটা আমি লিখেছি’। সেটিই ছিল বিদ্রোহী কবিতা। সেটি জানুয়ারি মাসেই বিজলী পত্রিকায় প্রকাশ হয়। আজও ৯ জানুয়ারি। এ বছরই নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার ১০০ বছর পূর্ণ হবে। তাই আমার মনে হয় তাঁকে সম্মান জানানোর ক্ষুদ্র কিন্তু সফল চেষ্টাটি আমরা করতে পেরেছি। আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও নজরুলকে তাঁর ৭৪ বছর বয়সে দেশে এনে নাগরিকত্ব প্রদান করে জাতীয় কবির সম্মান দিয়েছেন। তাদের দুজনেরই স্বপ্ন ছিল দেশ থেকে দুঃখ-দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং সোনার বাংলা বিনির্মাণ। আমাদেরও কাজ হবে সে লক্ষে কাজ করা।’
সভাপতির বক্তব্যে সাদাত জামান খান বলেন, ‘কবি নজরুল সাম্যের কথা বলেছেন। তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে, কবিতার মাধ্যমে নেচে বেড়িয়েছেন সর্বত্র। তিনি অস্থিতিশীল অবস্থার অবসানের জন্য প্রতিবাদী হয়েছেন। আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর এই ভূমিকাকে আসলে খুবই ইতিবাচক অর্থে ‘নৈরাজ্যবাদ’ বলা যায়। অর্থাৎ তিনি পুরোপুরি পুঁজিবাদ বা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন বলা যায় না।’