রুশো মাহমুদ »
হবে কী, হবে না! দোলাচল। নেপথ্যে ভূরাজনীতি, ভৌগোলিক ও কৌশলগত অবস্থান। স্বপ্নের শুরু সোনাদিয়ায়। অবশেষে বাস্তবে ধরা দিয়েছে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে মাতারবাড়িতে। সৌভাগ্যগুণে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা নামানোর জেটি এখন পরিণত হতে চলেছে বড় সমুদ্রবন্দরে। গভীর সমুদ্রবন্দরের এলিট ক্লাবে বাংলাদেশ প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের মাতারবাড়িতেই হচ্ছে সাড়ে ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট গভীরতার বন্দর, যা সবচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ার জন্য যথেষ্ট।
বঙ্গোপসাগর কৌশলগতভাবে এমন গুরুত্বপূর্ণ যে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে পিছপা হবে না জাপান, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো।
সিঙ্গাপুরের মতো দেশের আয় রোজগারের বড় খাত হচ্ছে গভীর সমুদ্রবন্দর। তাত্ত্বিকভাবে সমুদ্রবন্দর হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো, যা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব ফেলে। রপ্তানিমুখী শিল্প গড়ে ওঠা, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয় বাড়াতে এ ধরনের বন্দর জোরালো ভূমিকা রাখে। একটি গভীর সমুদ্রবন্দর শুধু স্থানীয় বা জাতীয় নয়, আঞ্চলিক অর্থনীতির জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানই দেশটির জন্য এক বড় সুযোগের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের এমন জায়গায়, যার আশপাশের দেশগুলোর অনেক অঞ্চল পুরোপুরি ভূমিবেষ্টিত, সমুদ্রের প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দর কাজে লাগবে সাত উত্তরÑপূর্ব ভারতীয় রাজ্য (সেভেন সিস্টার্স), নেপাল ও ভুটান। এমনকি চীনের কুনমিং বা মিয়ানমারের শান ও রাখাইন রাজ্যও এই বন্দরের সুফল পাবে।
বিস্তীর্ণ লবণ মাঠে জাপানের কাশিমা বন্দরের আদলে গড়ে ওঠছে আশা জাগানিয়া আগামীর বন্দর। এক্সকেভেটেড ও বেসিন পদ্ধতি অনুসরণ করে এই বন্দরের কাজ ইতোমধ্যে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তৈরি হয়ে গেছে ১৪.৩ কিলোমিটারের চ্যানেল। বন্দর সুবিধায় সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে এই মাতারবাড়ি। এই বন্দরের মাধ্যমে সমুদ্রপথে আমদানি বাণিজ্য অত্যন্ত কস্ট এফেক্টিভ হবে। চট্টগ্রাম বন্দরে এখন গড়ে প্রতিটি জাহাজে ১ হাজার ৮৭৮টি কনটেইনার পণ্য আনা-নেওয়া হয়। মাতারবাড়িতে চট্টগ্রাম বন্দরে চলাচলকারী চারটি জাহাজের সমান কন্টেইনার আনা-নেওয়া করা যাবে এক জাহাজে। বন্দর সুবিধা অনুযায়ী ১৪-১৫ হাজার একক কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভেড়ানো যাবে। ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা হবে। আমাদেরকে আর সিঙ্গাপুর, কলম্বো কিংবা কেলাঙ বন্দরের মুখাপেক্ষি হতে হবে না। ট্রান্সশিপমেন্ট অন্য দেশে নয়, নিজের দেশের অভ্যন্তরেই হবে এবং ব্যয় সাশ্রয়ীও হবে।
মাতারবাড়ি বন্দর থেকে চকরিয়া পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে একটি রাস্তা সরাসরি হাইওয়ের সাথে যুক্ত হবে। পাশাপাশি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষও বন্দরের ভেতর রেল যোগাযোগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ নদীপথ, রেলপথ ও সড়কপথে বন্দরের সাথে ত্রিমুখী যোগাযোগ থাকবে, আর ডাবল গেজ ট্রেন লাইন সুবিধার কারণে কন্টেইনার বহনের ক্ষেত্রে সক্ষমতাও বেশি থাকবে।
সোনাদিয়ায় যে স্বপ্নের শুরু, যার জাল বুনে দিয়েছিল একটি জাপানি সমীক্ষা। নানা প্রতিকূলতা ঠেলে আবার সেই জাপানের হাত ধরেই বাস্তবায়ন হচ্ছে স্বপ্নÑসাধের গভীর সমুদ্রবন্দর। এই এলাকায় গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ার প্রবল আগ্রহী চীনকে সরিয়ে জাপান ভূকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানটিকে ধরে রেখেছে। শক্তিবলয়ের দুই বড় শক্তিই এখন বঙ্গোপসাগরে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করে ফেলেছে। চীন মিয়ানমারে আর জাপান বাংলাদেশে। এ যেন শক্তির ভারসাম্য!
আমরা চাই এই বন্দরের উপকারভোগী শুধু বাংলাদেশ নয়-চীন, জাপান, ভারতসহ সবাই সুবিধাভোগী হোক। ভিন্ন শক্তিবলয়ে থেকেও সবপক্ষের বাণিজ্যিক সমৃদ্ধিই এনে দেবে শান্তির বারতা। এক্ষেত্রে নিজেদের স্বার্থরক্ষা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিসাবÑনিকাশে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি আমাদের অত্যন্ত সচেতন ও সজাগ থেকে করতে হবে ।