অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের বড় চমক দেখিয়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের একটি নিবন্ধে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তেজি অর্থনীতির উদাহরণ হয়ে উঠেছে বলে বর্ণনা করা হয়। ‘বাংলাদেশ ইজ বিকামিং সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক বুল কেইস’ শিরোনামে ঐ জার্নালের নিবন্ধে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও ভিয়েতনামের সাথে তুলনা করা হয়েছে। গত এক দশকে ভারতÑপাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের রপ্তানি বেড়েছে।
নিবন্ধে বলা হয় উন্নয়নশীল দেশে সুপারিশ অর্জনের পেছনে রয়েছে বাংলাদেশের কর্মক্ষম বিশাল তরুণ গোষ্ঠী, মজুরির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা এবং শ্রমক্ষেত্রে নারীর অধিক অংশগ্রহণ। নিবন্ধটির বক্তব্য খুবই ইতিবাচক, তবে রপ্তানিক্ষেত্রে অতিমাত্রায় তৈরি পোশাক নির্ভরতা আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ।
আমাদের অতীতের রপ্তানি পণ্য যেমন পাট, চামড়াসহ রপ্তানি পণ্যের আইটেম বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যে সুপারিশ জাতিসংঘ করেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে যে সব সুবিধা হারাতে হবে তা পূরণে সক্ষমতা অর্জনে আমাদের সকল প্রচেষ্টা নিয়োজিত করতে হবে।
অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘ডব্লিউইএফÑএর বৈশ্বিক লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদনÑ২০২০’ এ বলা হয়েছে, এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় উন্নতির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস প্রতিবেদনে ৪টি প্রধান সূচকের ১৪টি উপসূচকের ৪টিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সবদেশের ওপরে স্থান করে নিয়েছে। এই ৪টি উপসূচক হলো ছেলে ও মেয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তি, মাধ্যমিকে ছেলে ও মেয়ের সমতা, জন্মের সময় ছেলে ও মেয়ে শিশুর সংখ্যাগত সমতা ও সরকার প্রধান হিসেবে কত সময় ধরে একজন নারী রয়েছেন। নারীÑপুরুষের সমতার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন ৫০তম অবস্থানে রয়েছে। আর দক্ষিণ এশিয়ায় ১ নম্বরে। ভারতের অবস্থান ৪ নম্বরে, পাকিস্তান ৭ নম্বরে। ৪টি প্রধান সূচক যেমন নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ ও সুযোগ, শিক্ষায় অংশগ্রহণ, স্বাস্থ্য ও আয়ু এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ক্রম অগ্রগতি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
লিঙ্গবৈষম্য হ্রাস ও নারীর নানাবিধ ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নতির মূলে রয়েছে গত ১ দশকে দেশের ব্যাপক সামাজিক জাগরণ ও নারী ক্ষমতায়নের উত্থান। অনেক সামাজিক-ধর্মীয় প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও আমাদের দেশের নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য সামাজিক প্রগতির পরিচায়ক; কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, গ্রামীণ অর্থনীতিÑএসব সেক্টরে নারীরা ব্যাপক হারে অংশগ্রহণ করছেন। এতদসত্ত্বেও নারী অগ্রগতির ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যাও বিদ্যমান। বাল্যবিয়ের হার এখনও বেশি, গ্রামাঞ্চলে নারীদের ওপর সামাজিক-ধর্মীয় বিধিনিষেধ প্রবল, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিও আশানুরূপভাবে হচ্ছে না। তদুপরি নারীদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাও নারীর অগ্রগতির পথে অন্তরায়। পরিবারে পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর ক্ষমতায়নে প্রবল বাধাস্বরূপ। বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মসংস্থানে ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করছে, সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের কারণে গরিব ও নি¤œবিত্ত নারীদের মর্যাদার সাথে জীবনযাপনে কিছুটা হলেও সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
এটি নিঃসন্দেহ যে, বর্তমান করোনাকাল আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এই সময়ে আমাদের দেশের নারীরাও অনেক ক্ষেত্রে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়েছেন। তবে করোনায় স্বাস্থ্য সুবিধা, সামাজিক ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বব্যাপী প্রশংসা পেয়েছে। আমাদের কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ, তরুণ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, প্রবাসী কর্মজীবী দেশের এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিপুল ভূমিকা রাখছেন। আমরা আশা করি সরকার ও জনগণের সম্মিলিত প্রয়াসে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতি নতুন করে এগিয়ে চলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবে।
মতামত সম্পাদকীয়