সুপ্রভাত ডেস্ক :
আমি বাবা মায়ের শত আদরের মেয়ে, আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে, আমার দু’চোখে অনেক স্বপ্ন থাকে, আমি পড়ালেখা শিখতে চাই। এই কথাগুলোর সঙ্গে পরিচয় নেই নব্বই দশকের এমন ছেলেমেয়ে পাওয়া কষ্ট না প্রায় অসম্ভবি বটে। ছোট্ট মীনার সমাজ-সংস্কার ও জ্ঞানের আলোয় মানুষকে সচেতন করে তুলছে। সঙ্গে তার ছোট ভাই রাজু আর টিয়া পাখি মিঠু।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন কার কথা বলছি। হ্যাঁ, বিংশ শতকের শেষের দিকের বিনোদনের অন্যতম এক উপকরণ মীনা কার্টুনের কথাই বলছি। আজ মীনা দিবস। মীনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনা করে ১৯৯৮ সালে সার্কের পক্ষ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরকে ঘোষণা করা হয় মীনা দিবস। সেসময় থেকে প্রতি বছর ২৪ সেপ্টেম্বর দিনটি পালিত হয়ে আসছে মীনা দিবস হিসেবে।
চলুন মীনার যাত্রা কীভাবে হয়েছিল জেনে নেই। ১৮৯০ সালে বিশ্বব্যাপী চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হলেও অ্যানিমেশনের যাত্রা অবিশ্বাস্যভাবে এর অনেক আগে, ১৬০০ সালের গোড়ার দিকে। মূলত অ্যানিমেশনের ধারণা পাওয়া যায় খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ আগে। পটের মধ্যে মানুষের হাঁটার প্রতি পদক্ষেপের ছবি পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় সেখানে থেকেই এই অসাধারণ বিষয়টার যাত্রা শুরু। এছাড়া লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির আঁকাতেও এর ছায়া দেখা যায়। ১৯০৬ সালের আগে ম্যাজিক লানটার্ন, থাউমাট্রোপ, ফিনাকেটাস্কোপ, জয়ট্রোপ, ফ্লিপ বুক , প্রেক্সিনোস্কোপের মাধ্যমে অ্যানিমেশন দেখানো হত।
তবে বাংলাদেশে এর যাত্রা বহু পরে। ১৯৩৪ সালে গুণময় ব্যানার্জী নামে এক বাংলাদেশী ব্যক্তি প্রথম অ্যানিমেশন তৈরি করেন। যেটার নাম ছিল “দ্য পি ব্রাদার্স”। তবে আজ পর্যন্ত এর কোনো কপি পাওয়া যায়নি। এবং এটা কোথায় সংরক্ষিত আছে তাও কেউ জানেন না। অন্যদিকে ১৯৬০ সালে এক বাঙ্গালী “মন্দার মল্লিক” মন্দার স্টুডিও নামে কলকাতায় এক অ্যানিমেশন স্টুডিও চালু করেন এবং কিছু অ্যানিমেশন বানানোর চেষ্টা করেন।
এরপর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম অ্যানিমেশন দেখা যায় ১৯৮০ সালে। ন্যাশনাল টেলিভিশন প্রযোজনায় যেটা ছিল একটা টিভি বিজ্ঞাপন (নাম পাওয়া যায় নি)। এরপর একটা লম্বা বিরতির পর ১৯৯৭ সালে রিয়াজুল করিম ইউনোস্কোর এক প্রকল্পে টেলিভিশনের জন্য একটা এক মিনিটের বিজ্ঞাপন বানান। যা শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর উপর ছিল। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে জনপ্রিয় টেলিভিশন কার্টুন মিনা চালু হলেও এটি মূলত মুম্বাইতে তৈরি হত। কিন্তু ১৯৯৭ সালের পরের পর্বগুলো বাংলাদেশীদের হাতেই তৈরী হয়।
এদিকে ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে প্রথম অ্যানিমেশন ওয়ার্কশপ হয়। যেখানে কীভাবে অ্যানিমেশন তৈরি হয় এবং এর টেকনিক্যাল দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। এরপর অনেকেই ছোট আকারে অ্যানিমেশনের কাজ শুরু করে। মীনা কার্টুন শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন ভাষায় নির্মিত একটি জনপ্রিয় টিভি কার্টুন।
তবে মীনা কার্টুন প্রথম বের হয় ধারাবাহিকভাবে কমিক বই আকারে। ১৯৯১ সালে ইউনিসেফের উদ্যোগে কার্টুন চরিত্র হিসেবে মীনার জন্ম। এর জনক মুস্তাফা মনোয়ার। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৯৫ সালে বিটিভিতে মীনা কার্টুন দেখানো শুরু হয়। তবে মীনার শুরুর শুরুটা ছিল বেশ নাটকীয়। নব্বইয়ের দশকের কথা। মেয়েদের অধিকার সুংসহত করার ব্রত নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত তৎকালীন সাতটি দেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা, ভূটান ও মালদ্বীপ) যৌথভাবে দশকটি ‘কন্যাশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। এ অঞ্চলটিতে সত্যিকার অর্থেই মেয়েদের তখন নাজুক অবস্থা! কী স্বাস্থ্য, কী শিক্ষা- সব ক্ষেত্রেই মেয়েদের করুণ দশা। ১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত ১০ বছর পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সার্বিক সূচকে মেয়েদের অবস্থার উন্নয়নের জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলো দৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করে। আর সেজন্য চাই সামাজিক সচেতনতা। কিন্তু মেয়ে শিশুর অধিকারের ব্যাপারে কীভাবে সচেতন করা যায় এ অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠীকে?
যোগাযোগ করা হলো ‘ইউনিসেফ’ এর সঙ্গে। আরো সঠিকভাবে বললে ‘ইউনিসেফ, বাংলাদেশ’ এর সঙ্গে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য কোনো এক বিখ্যাত চরিত্রের দ্বারস্থ হতে হবে, হতে পারে সেটা বাস্তবের কোনো কিংবদন্তী কিংবা কৃত্রিমভাবে সৃজিত কোনো চরিত্র, মানে কোনো এনিমেটেড কার্টুন বা কমিক্স চরিত্র। সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির বিষয়ে সাধারণত কোনো একজন বিখ্যাত ব্যক্তি, যার কথা মানুষ মনোযোগ দিয়ে শুনবে, গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করবে। এমন একজনকেই এর দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বাংলাদেশের প্রথিতযশা চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার তখন বিটিভিতে ‘মনের কথা’ নামে একটি পাপেট শো করতেন। সেখানে পারুল নামে এক বিখ্যাত মেয়ে চরিত্র বাংলাদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এই পাপেট পারুলের থিম থেকেই একটি কাল্পনিক মেয়ে চরিত্র নির্মাণের কনসেপ্ট গ্রহণ করা হয়। এ কাজে বাংলাদেশ থেকে মুস্তাফা মনোয়ার যুক্ত ছিলেন। এরপর আট-নয় বছর বয়সী মেয়ের কনসেপ্ট মোটামুটি দাঁড়ালো। দক্ষিণ এশিয়ার গ্রামীণ আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরার জন্য শহুরে নয়, গ্রামীণ আবহ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এর সঙ্গে থাকবে মেয়েটির বাবা, মা, ছোট ভাই এবং পোষা কোনো প্রাণী। তবে কি নাম দেয়া হবে এই চরিত্রের তাই নিয়ে শুরু হয় জল্পনা কল্পনা। কেননা সাত সাতটি দেশেই নামটির গ্রহণযোগ্যতা থাকতে হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে মেয়েটির নাম রাখা হলো ‘মীনা’। কারণ ভারত-বাংলাদেশ-শ্রীলংকায় এই ধরনের নাম (যেমন- মীনাক্ষী, মীনা কুমারি) খুব প্রচলিত। আবার, শোনা যায়, মীনা নামটির সঙ্গে‘আমিনা’ নামের কিছুটা সাযুজ্য থাকায় মুসলিম দেশগুলোও, বিশেষত পাকিস্তান, এই নামে আপত্তি করেনি। অবশেষে সব দেশের অনুমোদন সাপেক্ষে চূড়ান্ত হয় ‘মীনা’ নামটি। উল্লেখ্য, সিন্ধী ভাষায় ‘মীনা’ শব্দটির অর্থ ‘আলো’।
১৯৯৮ সালে মীনা কার্টুন নিয়ে ভিয়েতনামে প্রচারণা শুরু হয়। ভিয়েতনামি মূল ভাষা এবং আরো ৮টি স্থানীয় ভাষায় ভাষান্তর করা হয় মীনা কার্টুন। মজার কথা হচ্ছে, সেখানে কিন্তু মীনার নাম বদলে রাখা হয় ‘মাই’, যাতে করে নামটা স্থানীয় প্রচলিত নামের মতোই শোনায়!এরপর এর পার্শ্ব চরিত্র পোশাক সেট ডিজাইন।
সেই নব্বই দশক থেকে এখনো পর্যন্ত মীনার কদর কমেনি। বরং বেড়েই চলেছে। বিশ্বব্যাপী চলতি মহামারিতেও মীনার কাজ থেমে ছিল না। জীবাণু ধ্বংস করতে এবং সুস্থ থাকতে সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়ার কথা বলেছে বারবার। সামাজিক বিভিন্ন কর্মকান্ড, সচেতনতা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাল্যবিবাহ রোধ সবেতেই মীনার সজাগ দৃষ্টি। মীনা হয়ে উঠেছে সবার ঘরের মেয়ে। মীনা সাধারণত নারী শিক্ষার প্রতি বেশি জোর দয়েছে। এই প্রজন্মের কাছেও মীনা কার্টুন শিক্ষার পাশাপাশি বিনোদনের অন্যতম এক ক্ষেত্র। খবর : ডেইলিবাংলাদেশ’র।